কভিড-১৯ মহামারি আসার পর শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। পাঠগ্রহণ, পাঠ তৈরি, গেমস, বিনোদনসহ নানা কাজে শিশুরা ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। আর তা করতে গিয়ে তারা অনলাইনে নানাভাবে হেনস্তা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। ফলে শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট এখন সময়ের দাবি। আর তা নিশ্চিত করতে গেলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, একই সঙ্গে শিক্ষক ও অভিভাবকদের মাঝে ব্যাপকভাবে তৈরি করতে হবে সচেতনতা। ৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে সমকাল এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) যৌথভাবে আয়োজিত ‘শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা: উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক এক অনলাইন গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তা, মনোবিজ্ঞানী, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারাও এতে অংশ নেন।
মুস্তাফিজ শফি
দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ ভাগ শিশু। এই বিপুলসংখ্যক শিশুর অনেকেই সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে। অনেকে না বুঝে এই অপরাধে জড়িয়েও পড়ছে। তাদের এই অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা বলছি। এ ব্যাপারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশিকাও তৈরি করা হয়েছে। এই নির্দেশিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে। আমরা আশা করছি, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ ব্যাপারে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। এটা এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও কীভাবে সচেতন করা যায়, সে ব্যাপারে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
মো. আকরাম-আল-হোসেন
দেশের ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক কোটি ৪০ লাখ শিশু পাঠ গ্রহণ করছে। ১৭ মার্চ থেকে কভিড-১৯-এর কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের সংসদ টেলিভিশন, মোবাইল ফোনের রেডিওর মাধ্যমে পাঠদান করানো হচ্ছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আমরা প্রাথমিকের শিশুদের মায়েদের কাছে উপবৃত্তি পৌঁছে দিচ্ছি। প্রাথমিকের শিশুদের জন্য পাঠদানে ইন্টারনেটের ব্যবহার এখনও সীমিত থাকলেও শুরু হয়েছে। জেলা পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষকরা ইউটিউব, ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের ক্লাস প্রচার করছেন। কভিড-১৯ পরিস্থিতি প্রলম্বিত হলে আমরা শিশুদের পড়ালেখার বাইরে রাখতে পারব না। তাই ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়াতে হবেই। সে ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে একটা নীতিমালা থাকা দরকার। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তৈরি করা পুস্তিকাটি আমরা এখনও হাতে পাইনি। এটি পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। ২০২২ সাল থেকে প্রাথমিকের নতুন কারিকুলাম শুরু হবে। সেখানে শিশুদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার নিরাপদ করার বিষয়টি যুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে আইসিটি মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে আমরা যৌথভাবে কাজ করতে পারি।
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কোমলমতি শিশুরা এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। এই সুরক্ষা দিতে গেলে একটি নীতিমালা অবশ্যই থাকতে হবে।
শিশুরা যেন সাইবার জগতে কোনোভাবেই আসক্ত হয়ে না পড়ে, সেদিকে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। যুগোপযোগী এমন একটি বিষয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়ায় সমকালকে ধন্যবাদ জানাই।
তাহমিনা রহমান
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মতো চ্যাটিং অ্যাপস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ফলে সবাই একে অন্যের কাছাকাছি চলে আসছে। সাম্প্রতিক করোনা মহামারির সময় শিশুরা অনলাইনে বেশি সময় কাটাচ্ছে। বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত বিজ্ঞাপন তাদের বিব্রত করছে। অনলাইনে ভুল তথ্য প্রচার আর সাইবার বুলিং বেড়েছে। বেশ ক’বছর ধরে কিশোরীরা অনলাইনে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রযুক্তির ব্যবহার-সংক্রান্ত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে শিশুদের একটা বড় অংশ প্রতিবন্ধী রয়েছে। তাদের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি। মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে শিশুদের জন্য সাইবার অপরাধ থেকে নিরাপদ থাকার বিষয়ে তেমন বলা হয়নি। এজন্য আসক নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারবিষয়ক একটি হ্যান্ডবুক তৈরি করেছে। এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
একেএম আফতাব হোসেন প্রামাণিক
সমকাল বাংলাদেশের একটি লিডিং দৈনিক পত্রিকা। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে। আজ তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু জাতির সামনে হাজির করেছে। শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেটের ব্যবহার। বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমরাও এর ক্ষতির শিকার হয়েছে। এর পরিসমাপ্তি কবে ঘটবে, তা এখনও আমরা জানি না।
২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে নাম লেখাতে আমরা কাজ করছি। আর এ ক্ষেত্রে আইসিটিভিত্তিক শিক্ষাই হলো আমাদের পাথেয়। তবে কোমলমতি শিশুদের জন্য ইন্টারনেট নিরাপদ করা না গেলে সব ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ইউনেস্কোর হিসাবমতে, প্রতি সেকেন্ডে সারা বিশ্বের এক লাখ ৯৮ হাজার শিশু ইন্টারনেটে প্রবেশ করছে। ইন্টারনেটের ভালো-মন্দ দুটি দিক রয়েছে। এটি বোঝার মতো বিচারবুদ্ধি শিশুদের নেই। এজন্য অভিভাবকদের সচেতন করতে ব্যাপকভাবে প্রচার দরকার। পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রমে এটি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সক্রিয় বিবেচনা করবে। আমরা এনসিটিবির সঙ্গে বসে কারিকুলাম, পাঠ্যবই রিভিউ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।
ড. আবদুল মালেক
আমাদের দেশে যত শিশু আছে, পৃথিবীর বহু দেশে তত জনসংখ্যাও নেই। সুতরাং বিশাল এই শিশুগোষ্ঠীর সাইবার সুরক্ষার বিষয়টি বিশালভাবেই উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে কন্যাশিশুদের সুরক্ষা বেশি জরুরি। শিক্ষাক্রমে এ বিষয়টি কেবল অন্তর্ভুক্ত করলেই চলবে না, পৃথিবীতে প্রযুক্তির ব্যবহারিক পরিবর্তন প্রতিনিয়ত ঘটছে, তাই কারিকুলামও প্রতি বছর পরিমার্জন করতে হবে।
আমাদের দেশে লিঙ্গভেদে শিশুদের মধ্যে নানা বৈষম্য রয়েছে। বিশেষত কন্যাশিশুদের ওপর বৈষম্য। এই বৈষম্য কমিয়ে আনাও শিক্ষার একটি বড় উদ্দেশ্য। প্রযুক্তির প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে সারা বিশ্বে। প্রতিনিয়ত এর হালনাগাদ সংস্করণ মানুষের হাতে আসছে। এসব প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিকটিও তাই নিত্যনতুন হবে। ব্যবহারকারীদের তা জানতে হবে। ইন্টারনেট তথা সাইবার বুলিং থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো থেকে তথ্য দিয়ে অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে।
শিক্ষা বলতে কেবল আনুষ্ঠানিক শিক্ষাই বোঝায় না। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকেও ব্যক্তি নানা কিছুই শেখে। তাই সাইবার অপরাধ সম্পর্কে এসব স্তরেও সচেতনতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। শিশুদের ক্ষতিকর কাজে যুক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। তাদেরও ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে হবে।
অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান
২০০৯ সালে আমাদের দেশে আইসিটি পলিসি হয়েছিল। দেশে আইসিটি এডুকেশন নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। তবে আইসিটি ইন এডুকেশন নিয়ে সেভাবে কোনো কাজ হয়নি। এর ভয়াবহ দিকগুলো মাথায় রেখে শিশুদের নিরাপদ করতে কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তকে সেগুলো আনতে হবে। কেবল পাঠ্যবইয়ে রাখলেই চলবে না, শিক্ষকদের জন্য প্রণীত টিচার্স গাইড ম্যানুয়েলেও তা রাখতে হবে। এগুলো করা না গেলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সত্যিই ভারনারেবল অবস্থায় পড়বে।
যে ইউটিউব ব্যবহার করে তার তথ্য চলে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষের কাছে। সে অনুযায়ী কনটেন্ট তার সামনে চলে আসছে। সাইবার অপরাধের যে ভয়াবহতা তা ঠিকমতো অ্যাড্রেস করা হয়নি। এ বিষয়ে আমরা সচেতন হয়েছি।
আসকের সুপারিশগুলো শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, শিক্ষক গাইডেও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে ইন্টারনেটের ব্যবহার ও নিরাপত্তা নিয়ে অভিভাবকদের জন্য একটি গাইড তৈরি করা জরুরি। কারণ তাদেরও সচেতন করতে হবে।
অধ্যাপক বেলাল হোসাইন
সারাদেশে ব্যাপকভাবে শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়টি প্রচার করতে হবে। এতে গণমাধ্যমেরও দায়িত্ব নিতে হবে। তাহলে অভিভাবক, শিক্ষক সবাই সচেতন হবেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে আমি এই গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিলাম। আজকের এ আলোচনার ফলাফল আমি আমার অফিসকে জানাব এবং আমাদের করণীয়গুলো আমরা অবশ্যই করব।
করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা এখন র্যানডমলি ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা ইউটিউব থেকে তাদের শিক্ষকদের পাঠ খুঁজে বের করে পাঠ গ্রহণ করছে। শিক্ষার্থীরা সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে অনলাইনে ঝুঁকে পড়েছে। আগামীতে ইন্টারনেটের ব্যবহার যে আরও বাড়বে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কেও শিক্ষক, অভিভাবক সবাইকে সচেতন হতে হবে।
অধ্যাপক মেহজাবীন হক
করোনা আসার আগে একটা ক্যাম্পেইন করেছিলাম প্রযুক্তিতে আসক্তি নিয়ে। করোনায় ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক বেড়ে গেছে। গ্রামের অভিভাবকরা সচেতন কম। এখন একটা স্মার্টফোন থাকলে সারা দুনিয়া হাতের মুঠোয় চলে আসে। ইন্টারনেটের নেতিবাচক প্রভাবে অনেকে ট্রমাটাইজ হয়ে যায়। অনেক বেশি সময় ইন্টারনেটে থাকলে মস্তিস্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, নেতিবাচক দিক বেশি বিকশিত হয়, এটার কারণে মানসিক উন্মেষও বাধাগ্রস্ত হয়। শিশু অ্যারোগেন্ট ও খিটখিটে মেজাজের হয়ে যায়। অটিস্টিক শিশুদের ৪৫ মিনিটের বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিলে রেডিয়েশনে তাদের মস্তিস্কের পাথে ভীষণ ক্ষতি হয়।
অম্বিকা রায়
করোনাকালীন পড়াশোনা এবং বিনোদনের জন্য শিশু-কিশোররা অনেক বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। কিন্তু ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে তাদের অনেকের ধারণা নেই বললেই চলে। ফলে অনলাইনে তারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। কিন্তু শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। কিন্তু মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে সাইবার অপরাধ বিষয়ে বলা হলেও সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে কোনো কিছু বলা নেই। তাছাড়া অনলাইনে শিশু যৌন নির্যাতন কী, অনলাইনে শিশু যৌন নির্যাতনের ধরনগুলো কী কী সে সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তকে পরিস্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন, যাতে করে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে অনলাইনে যৌন নির্যাতন থেকে নিজেকে প্রতিহত করতে পারে। সেজন্য পাঠ্যপুস্তকে পরিস্কারভাবে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, শিক্ষকদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারবিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া আসক ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যে প্রকল্পের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে তার উদ্দেশ্য হলো, নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কিত নির্দেশিকাটির কয়েকটি অধ্যায় শিশুদের শ্রেণি উপযোগী করে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা।
হাসিবা হাসান জয়া
অভিভাবক আর শিক্ষকরাই যদি না জানেন কীভাবে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়, তাহলে শিশুরা জানবে কীভাবে? তাই আগে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতনতা দরকার।
অনেক অভিভাবক না বুঝে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন-ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিশু অ্যারোগেন্ট, খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। অটিস্টিক শিশুদের ৪৫ মিনিটের বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিলে রেডিয়েশনে তাদের মস্তিস্কের পাথে ভীষণ ক্ষতি হয়। বাবা-মাকে জানতে হবে কোন কোন সাইট লক করে রাখতে হবে, যা শিশুদের দেখানো যাবে না। এসব জানতে হবে শিক্ষকদেরও।
প্রিয়তা ত্রিপুরা
আমাদের লার্নিং সেন্টারগুলোতে অটিজম ও প্রতিবন্ধী শিশুরা আসছে। দেখা যাচ্ছে, ইন্টারনেট ব্যবহারে তাদের দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে। অনেকটা নির্ভরও হয়ে পড়ছে। তবে কথা হলো, শিশুরা এমনিতেই স্পর্শকাতর। আর প্রতিবন্ধী শিশুরা তো আরও বেশি। দেখা যাচ্ছে, প্রতিবন্ধী শিশুরা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে তারা তা বলতে পারে না। বলতে চায়ও না। অনেক জিজ্ঞাসা করার পর তারা তা জানায়।
শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে আনতে হবে।
জেনিফার আলম
মহামারিকালে শিশুরা বেশি করে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, একই সঙ্গে বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। বাবা-মায়েরা এ থেকে পরিত্রাণের পথ জানেন না বলে শিশুদের রক্ষা করতে পারেন না। পাঠ্যবইয়ে যেমন ওয়াশরুম থেকে এসে হাত ধোয়ার বিষয়টি তুলে ধরে শিশুদের শেখানো গেছে, ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকার বিষয়টিও তেমনিভাবে পাঠ্যবইয়ে তুলে ধরে সবাইকে শেখাতে হবে।
আজ আমরা নিরাপদ ইন্টারনেট শিশুদের জন্য নিশ্চিত করার কথা যখন বলছি, তখন দেখতে পাচ্ছি, বাবা-মায়েরা নিজেরাই সাইবার বুলিং থেকে নিরাপদ থাকতে পারছেন না। তাহলে তারা শিশুদের কীভাবে বাঁচাবেন। আরেকটি বিষয় হলো, সামাজিক মাধ্যমের কারণে শিশুদের ব্যক্তিগত তথ্য সব বাইরে চলে যাচ্ছে। তারা ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
রেজাউল করিম সিদ্দিকী
বর্তমান ডিজিটালাইজেশনের যুগে বাবা-মায়ের সচেতনতায় ঘাটতি থাকলে চলবে না। কেবল তারা নন, সমাজের সব দিক থেকে সবাই মিলে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এসব বিষয়ে আইনের ঘাটতি নেই। তবে সেগুলো বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। সম্মিলিতভাবে একটি আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।
শাহরিয়ার কবির
আমরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করি। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের আইসিটি সম্পর্কে যেসব প্রাথমিক তথ্য জানা থাকা প্রয়োজন, সে বিষয়ে অধিকাংশের ধারণা নেই। এই তথ্যগুলো যদি প্রাথমিকের পুস্তকে থাকে, তাহলে তারা এ বিষয়ে আগ্রহী হবে। তাদের কর্মে সুযোগ উন্মুক্ত হবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের আইসিটি সম্পর্কে যেসব প্রাথমিক তথ্য জানা থাকা প্রয়োজন, সে বিষয়ে অধিকাংশের ধারণা নেই। এই তথ্যগুলো যদি প্রাথমিকের পুস্তকে থাকে, তাহলে তারা শেখার বিষয়ে আগ্রহী হবে। নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারবে। ফলে তাদের কর্মের সুযোগ আরও উন্মুক্ত হবে। ইন্টারনেটে প্রতিবন্ধী শিশুদের উপযোগী কনটেন্টের পরিমাণ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। অভিভাবক আর শিক্ষকদেরও প্রতিবন্ধীবান্ধব শিক্ষাক্রমের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। কারণ পরিবার থেকেই শিশুরা প্রথম শিক্ষা পাবে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা বিকশিত হবে। সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে তথ্যপ্রযুক্তি পিছিয়ে পড়া প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবে।
ইসহাক শাহীন ভূঁইয়া
পাঠ্যপুস্তকগুলোতে প্রযুক্তির যে বইটি রয়েছে, তা প্রতিবন্ধীদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষক, অভিভাবকসহ শিক্ষা-সংশ্নিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে। কারণ একজন স্বাভাবিক শিশুর চেয়ে একজন প্রতিবন্ধী শিশুর প্রযুক্তির সহায়তা বেশি প্রয়োজন।
অনেক অভিভাবক না বুঝে শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছেন। এতে শিশুদের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে হতাশা ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যায়। মহামারিকালে শিশুরা বেশি করে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। এতে বেড়েছে সাইবার বুলিং। বাবা-মায়েরা এ থেকে পরিত্রাণের পথ জানেন না বলে শিশুদের রক্ষা করতে পারেন না।
আব্দুস সবুর বিশ্বাস
কাজ করতে গেলে তৃণমূল থেকে বলা হচ্ছে, নিরাপদ ইন্টারনেটের বিষয়গুলো পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত হোক। শিশুরা অভিভাবকের চেয়ে শিক্ষকদের কথা বেশি শোনে। তাই পাঠ্যপুস্তকে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে শিশুরা সচেতন হবে। অভিভাবকরাও সচেতন হবে।
মহামারি আসার পর শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। শিক্ষা, বিনোদনসহ নানা কাজে শিশুরা ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। আর তা করতে গিয়ে তারা অনলাইনে নানাভাবে হেনস্তা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। কারণ অধিকাংশ শিশুর নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা কম। তাদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট এখন সময়ের দাবি। আর তা নিশ্চিত করতে পাঠ্যপুস্তকে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষক, অভিভাবকসহ সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
শারমীন সুব্রিনা
অনলাইনেও শিশুরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এতে তাদের মধ্যে হতাশা ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যায়। কর্মক্ষেত্রে সে আরও নির্যাতিত হলেও কারও সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না। শিশুদের যৌন নির্যাতনের ছবি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করলে শিশুদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। ডিজিটালাইজেশনের যুগে বাবা-মায়ের সচেতনতায় ঘাটতি থাকলে চলবে না। কেবল তারা নন, সমাজের সব দিক থেকে সবাই মিলে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে সাইবার অপরাধ বিষয়ে বলা হলেও নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু বলা নেই। অনলাইনে শিশু যৌন নির্যাতন বিষয়টিও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সবাই একসঙ্গে কাজ করলে শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট দেওয়া সম্ভব হবে।
আপনার মতামত জানানঃ