বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে হাওয়ার মতো। ইউরোপ আমেরিকাসহ আরও বহু দেশই করোনার বিষদাঁত ভালোভাবেই প্রত্যক্ষ করেছে। সেই হিসাবে জনসংখ্যার আধিক্য থাকলেও করোনা তার বিষদাঁত তেমন একটা দেখাতে পারেনি বাংলাদেশে। তবে ভাইরাসের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে দেখা দিয়েছে এদেশে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা। আসলে দেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন। চলতি বছরের প্রথম মাসেই ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে দুই শতাধিক। যা শুধু আলোচনায় এসেছে, সেগুলোই জানান গেছে। এর বাইরে তো রয়েছে অনেক। লোক-লজ্জা বা সম্মানের ভয়ে প্রকাশ করেনি ভুক্তভোগীরা। তবুও আলোচনায় আসা যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যাও ওজনে অনেক ভারী। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শিশু নির্যাতন উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ১৩৯ জন কন্যাশিশু নির্যাতন এবং ১০৮ জন নারী ধর্ষণের ঘটনাসহ মোট ২৫৯ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। আজ সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানায় সংস্থাটি।
সংস্থার লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
মহিলা পরিষদ জানায়, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ২৫৯ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০৮ জন। এর মধ্যে ৭২ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার এবং ৭ কন্যাশিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া ৪ শিশুসহ ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে ১ জন। ৬ জন শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছে ৩ জন, যার মধ্যে একটি শিশু।
এছাড়াও অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছে ১ জন। উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ৩ জন। শিশু অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ১৮টি। পাচারের শিকার হয়েছে ১ জন। বিভিন্ন কারণে ১৫ শিশুসহ ৪১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। যৌতুকের কারণে নির্যাতন হয়েছে ৬ জন, এর মধ্যে ২ জন যৌতুকের কারণে হত্যা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫ শিশুসহ মোট ১৫ জন। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছে ৭ জন, যার মধ্যে একজন আত্মহত্যার প্ররোচণার শিকার হয়েছে। ৮ শিশুসহ ২১ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ৪টি। সাইবার ক্রাইম অপরাধের শিকার ২ শিশুসহ ৬ জন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশকে নারী ও শিশুবান্ধব বলার কোনো উপায় নেই। নারী ও শিশুরা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা করার পর বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, মামলা আপস করা, অপরাধীদের শাস্তি না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে নারী নির্যাতন কমছে না। ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। আসামিদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হলে ধর্ষণের ঘটনা কমানো সহজ হতো।
দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবারে এ ধরনের ঘটনা লুকিয়ে রাখার প্রবণতা প্রকট। ধর্ষণের শিকার শিশুর শারীরিক অবস্থা গুরুতর না হলে বা হত্যা-আত্মহত্যার ঘটনা না ঘটলে সাধারণত আইনি সহায়তা নেওয়া হয় না। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই বেশির ভাগ সময় এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাদের ভয়ে পরিবার মামলা করতে সাহস পায় না। আবার মামলা করলেও আপস করে ফেলতে হয়। সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকায় অনেক সময় সাক্ষী পাওয়া যায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ধরনের ঘটনায় পরিবারকে প্রতিবাদী হতে হবে। পরিবার ও আক্রান্তকে বুঝতে হবে, এতে তাদের কোনো দায় নেই। এ লজ্জা অপরাধীর। তারা মনে করেন, আইনি সহায়তা নেওয়ার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি নয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এ জন্য আইনেরও পরিবর্তন প্রয়োজন।
বিচারহীনতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, শিশু ধর্ষণের ঘটনায় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আইনবিদরা বলছেন, এ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য মামলার সঠিক তদন্ত ও আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। সমাজবিজ্ঞানীরা বর্তমান সময়ে এ ধর্ষণকে ব্যাধি হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। আর এ ব্যাধির জন্য দায়ী করেছেন পরিবার, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবক্ষয়কে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের সমস্যা সমাধানে মামলার সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। বিচারকার্য যেন অতি দ্রুত সম্পন্ন হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রথমত, আদালত কর্তৃক খুব দ্রুত অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যদি অপরাধীদেরকে দ্রুত ধরা হয় এবং তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় তাহলে হয়তো আমরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি। বিচার শুরু হলে কোনো অবস্থাতেই যেন বিচারকার্য মুলতবি না হয়। অনেক সময় বিচার কার্য মুলতবি হয়ে যায়। ফলে বিচার বিলম্বিত হয়। তারা বলেন, আইনশৃঙ্খলার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নজর দিতে হবে আইনের প্রয়োগটা যেন কঠিন এবং কঠোর হয়। অপরাধীরা যেন এই বার্তাটি পায় যে প্রশাসন আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করছে এবং এ বিষয়ে আমরা সবাই যত্নবান। এটা হলে অপরাধীরা অপরাধ করার আগে অন্তত দশবার চিন্তা করবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০৩
আপনার মতামত জানানঃ