প্রায় আড়াই হাজার দুর্নীতির মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। মামলায় গুরুতর অভিযোগ হ’ল- অবৈধ সম্পদ অধিগ্রহণ, সম্পদের অপব্যবহার, ঘুষ, সরকারী তহবিলের আত্মসাৎ,সরকারী ক্রয়ে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ইত্যাদি।
তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সংশ্নিষ্ট থানা ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কার্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে এসব মামলা দায়ের করা হয়। দুদকই এসব মামলার বাদী। মামলার বিভিন্ন ধাপে পক্ষগুলো বিচারিক আদালত থেকে উচ্চ আদালতে ও সর্বোচ্চ আদালতে আইনি প্রতিকার নিতে আসে। দুদকের আলোচিত মামলার সংখ্যা উচ্চ আদালতে দিন দিন বাড়ছে।
উচ্চ আদালতে এসব মামলার মধ্যে রয়েছে- ক্রিমিনাল, রিট, আপিল, ক্রিমিনাল মিস, ক্রিমিনাল রিভিশন, কোম্পানি মামলা ও আদালত অবমাননা মামলা। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, কোনো ব্যক্তির সম্পদের হিসাব চাইলে তিনি হাইকোর্টে দুদকের ওই নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট মামলা করেন। সেটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দুদক তার কার্যক্রম শুরু করতে পারে না। এমন বহু মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন।
মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুদক যদি কোনও ব্যক্তির সম্পদের হিসাব চায় তবে নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে প্রথমে একটি রিট আবেদন করা হয়। এরপরে রিটকে দুদকের তদন্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল। এরপরে মামলার কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট করা হয়। পরে এই সাজার বিরুদ্ধে জুডিশিয়াল কোর্টে আপিল করা হয়েছিল। যদি এটি হাইকোর্টে বহাল থাকে, তবে এটি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়। একবার আপিল নিষ্পত্তি হয়ে গেলে, একটি পর্যালোচনা চাওয়া হবে। অন্যদিকে, কেউ খালাস পেলে, জামিন মঞ্জুর বা বিচারিক আদালতে মুক্তি পেলে দুদকও হাইকোর্টে যান। এভাবেই আইনী লড়াই চলে। ফলস্বরূপ, কেস নিষ্পত্তি করতে কয়েক বছর সময় লাগে।
উচ্চ আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত উচ্চ আদালতসহ সারাদেশে বিভিন্ন আদালতে দুদকের দায়ের করা বিচারাধীন মামলা রয়েছে পাঁচ হাজার ৩৯৮টি। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ৪২২টি, হাইকোর্ট বিভাগে দুই হাজার ৫৩টি, ঢাকার আদালতে ৮২৭টি এবং ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলায় দুই হাজার ১০৪টি। এই সময়ে সাজা হয়েছে ১১১ জনের, খালাস পেয়েছেন ৪৪ জন এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫৫টি মামলা। সর্বোচ্চ আদালতে ৯৫টি মামলা এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৬৯০টি দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আপিল বিভাগে ৪৬টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৩০৪টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। অবশ্য গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টসহ সারাদেশে আরও কিছু মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি হয়েছে।
এ ছাড়া ২০০৪ সালে বিলুপ্ত হওয়া দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে করা ৪৫১টি মামলার মধ্যে ২৪৯টি চলমান এবং উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে ২০২টি।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, উচ্চ আদালতে দুর্নীতির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। দুর্নীতির মামলার বিচার দ্রুত না হলে দুর্নীতি রোধ যাবে না। প্রয়োজন হলে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপ করে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে বেঞ্চ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, কমিশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমরা এরই মধ্যে চিঠি দেওয়া শুরু করেছি- উচ্চ আদালতে তাদের কী পরিমাণ ও কোন কোন ক্যাটাগরির মামলা রয়েছে, তার তালিকা দেওয়ার জন্য। এগুলো পাওয়ার পর অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে ওই সব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, উচ্চ আদালতের বিভিন্ন বেঞ্চে মামলা নিষ্পত্তির জন্য ৪৫ জনের একটি আইনজীবী প্যানেল রয়েছে। এ সব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে শুনানির জন্য হাইকোর্ট বিভাগে পৃথক তিনটি বেঞ্চ (এনেক্স ১৭, ২৭ ও মেইন ভবনের ২৫ নম্বর কোর্ট) রয়েছে। আরও দুটি বেঞ্চ গঠনের প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্নিষ্ট আইনজীবীরা। গত বছর শুরুর দিকে দুদক থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে বেঞ্চ বাড়ানোর সুপারিশ করে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ ছাড়া ঢাকা জজকোর্টে পৃথক ১৩টি বেঞ্চে দুর্নীতির মামলা শুনানি হচ্ছে। এসব বেঞ্চে দুদকের পক্ষে ১৩ আইনজীবী মামলা পরিচালনার কাজে নিয়োজিত। ঢাকার আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা আট শতাধিক।
এদিকে দুর্নীতির বিশ্বজনীন ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থা দুই ধাপ পিছিয়েছে। ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) বিশ্বজুড়ে দুর্নীতির ধারণাসূচক বা করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স (সিপিআই) ২০২০ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সিপিআই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। গত বছর ছিল ১৪তম। সূচকে উচ্চক্রম (ভালো থেকে খারাপের দিকে) অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এবারও ১৪৬তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ১০০ এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, আদালতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলা নিষ্পত্তি হতে বিলম্ব হচ্ছে। রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের অর্থ ও সম্পত্তি যারা লুট করেছে, তাদের বিচার দ্রুত করতে হবে। এদের অধিকাংশই সাজা পায় না। ফলে অপরাধও দিন দিন বাড়ছে। এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতিরা প্রায়ই মামলাজট নিরসনে কথা বলে থাকেন। এটা দৃশ্যমান বাস্তবায়ন হতে হবে। সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে বিচারক ও দুর্নীতি মামলার বেঞ্চ প্রয়োজনে আরও বাড়াতে হবে। অপরাধের বিচার বিলম্ব হওয়ায় সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে, ঠুনকো কোনো অজুহাতে মামলার বিচার কার্যক্রম মুলতবি করা যাবে না। একটা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে তার কার্যক্রম চালাতে হবে। দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান সমকালকে বলেন, উচ্চ আদালতে দুদকের প্রায় আড়াই হাজার মামলা বিচারাধীন। দুদকের প্রতিটি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইনজীবী প্যানেল কাজ করছে। যেসব মামলা নানা আইনি ব্যাখ্যার কারণে বিচারাধীন, সেগুলো আমরা ত্বরিতগতিতে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করছি। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতও যথাসময়ে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরাও চেষ্টা করছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয়ও ঘটছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা প্রতিপালন করা হলে মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়ে যাবে। মামলাজটও কমে আসবে। দুর্নীতির বিচারগুলো দৃশ্যমান হবে। পুরোনো ও চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির মামলা দ্রুতলয়ে নিষ্পত্তি করে অর্ধেকের নিচে নিয়ে আসা সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বিচারের জন্য শুনানির অপেক্ষায় থাকা মামলা প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইন অনুযায়ী ‘উপযুক্ত যৌক্তিক কারণ’ ছাড়া বিনা কারণে মামলা মুলতবি করা যাবে না। আইনে যেভাবে ১২০ দিন ১৮০ বা সুনির্দিষ্টভাবে মামলা নিষ্পত্তির বিধান আছে, সেটা মেনে চলতে হবে। তাহলে কোনো মামলাই দীর্ঘদিন আদালতে ঝুলে থাকবে না, দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। মামলাজট কমে আসবে এবং বিচারপ্রার্থীরও দুর্ভোগ কমবে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মামলা মুলতবির বিধান নেই। কিন্তু আমাদের দেশে মামলায় ঘন ঘন মুলতবি দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে বিচারককে আরও কঠোর হতে হবে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে, তৈরি হচ্ছে মামলাজট। বিচারক স্বল্পতা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও ব্যবস্থাপনা ত্রুটিই এর অন্যতম কারণ। এ জট নিরসনে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, তবে তা কোনো কাজে আসছে না।আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বর্তমান অবস্থায় জট কমাতে হলে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে মহাপরিকল্পনা।
এসডব্লিউ/এমএন/এফএ/১৬৫১
আপনার মতামত জানানঃ