চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল ঘিরে আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে সমুদ্রবন্দর, বিদেশি কোম্পানি আর ‘উন্নয়নের গল্প’। অন্তর্বর্তী সরকার আবুধাবিভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে এই টার্মিনাল ইজারা দিতে যেন অদৃশ্য এক তাড়াহুড়োয় নেমেছে। দরপত্র ছাড়াই, দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার স্বচ্ছতা ছাড়াই, জাতীয় কৌশলগত স্বার্থের খোলা মূল্যায়ন ছাড়াই—একটি রাষ্ট্রীয় বন্দরের অংশ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। চুক্তি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি, কিন্তু কোম্পানিটির কর্মকর্তারা বন্দরে যাতায়াত শুরু করেছেন, সরকারি উচ্চপর্যায় থেকে এই উদ্যোগের সমালোচকদের “প্রতিরোধ করার” আহ্বানও শোনা গেছে। একই সঙ্গে হঠাৎ করে বন্দরের মাশুলও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি, আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা ও সাধারণ ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালনা বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার পেছনে আসলে কী যুক্তি কাজ করছে, আর সেই যুক্তি কি সত্যিই দেশের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি কোম্পানির হাতে ইজারা দেওয়ার চিন্তা নতুন নয়। নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকেই এই চেষ্টা চলছে। তখন থেকেই বলা হচ্ছিল, বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর ‘অদক্ষ’, এখানকার কর্মক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম; তাই দেশ ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে। এই ভয়দেখানো যুক্তির ওপর ভর করেই ধীরে ধীরে সামনে আনা হয় ‘প্রাইভেট পোর্ট’–এর ধারণা। ১৯৯৭ সালের মার্চে এক ব্রিটিশ কনসোর্টিয়াম চট্টগ্রাম বন্দরের এলাকায় বেসরকারি বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। একই বছরের শেষে প্রস্তাব দেয় একটি মার্কিন কোম্পানি, পরে অস্ট্রেলীয়, লন্ডনভিত্তিক ও সিঙ্গাপুরি প্রতিষ্ঠানও প্রস্তাব জমা করে। দেশি-বিদেশি এসব কোম্পানির প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে সক্রিয় হয় নানা লবিস্ট নেটওয়ার্ক। অথচ একই সময় চট্টগ্রাম পোর্ট কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব উন্নয়ন প্রস্তাব ছিল, যা সহজেই বাস্তবায়নযোগ্য ছিল এবং জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর পথও দেখাত। কিন্তু সেই প্রস্তাব রাখা হয় ফাইলে, আর যত মনোযোগ বিদেশি কোম্পানির দিকে।
দ্রুতই মার্কিন এসএসএ নামের কোম্পানিটি সবার চেয়ে এগিয়ে যায়। কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার ছাড়াই তাদের সঙ্গে চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর মোহনায়, পতেঙ্গা এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দিয়ে নতুন কনটেইনার টার্মিনাল গড়ার চিন্তা সামনে আসে। প্রায় ২১ একর জমি প্রথমে ৯৯ বছরের জন্য, পরে ধাপে ধাপে আরও কয়েক দফা বাড়িয়ে একসময় ২১০ বছরের মতো দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যবস্থাপনার অধিকার দেওয়ার কাঠামো তৈরি করা হয়। অর্থাৎ প্রায় দুই শতাব্দী একটি কৌশলগত স্থাপনা কার্যত বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যাবে। এর নমুনা পরিকল্পনা তৈরির সময় মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে নানা কমিটি, ‘বিশেষজ্ঞ মতামত’ আর উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শকে যেভাবে সাজানো হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় কোন স্বার্থকে সামনে রেখে সবকিছু গুছিয়ে নেওয়া হচ্ছিল।
প্রস্তাবটি প্রথমে মন্ত্রিসভায় প্রাথমিক অনুমোদন পায়, পরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, এই প্রকল্পের বিষয়ে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে দরকষাকষি এবং “বিশেষজ্ঞ সেবা” পাওয়ার জন্য অবকাঠামোবিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক করা হবে। সেই প্রতিষ্ঠানের পেছনে ছিল বিশ্বব্যাংকের অর্থ ও নীতিমালা। ফলে, সরকারি কাগজে-কলমে এটি যেন “সরকারি” আর “আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন” পরামর্শকের ছাপ পায়। পরের সরকার ক্ষমতায় এলেও এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা থামেনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের নিয়ে গঠিত কমিটি মার্কিন কোম্পানির প্রকল্পের পক্ষে জোরালো সুপারিশ করে, যেন এটিই দেশের একমাত্র উদ্ধারকাঠি। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত সরাসরি নৌপরিবহনমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বলেন, এই চুক্তির জন্য কোনো টেন্ডার লাগবে না, আলোচনাগুলো নাকি “স্বচ্ছতার” সঙ্গে হয়েছে, আর বিশ্বব্যাংক-সমর্থিত পরামর্শক সংস্থা ইতিবাচক মত দিয়েছে। অর্থাৎ ‘স্বচ্ছতা’ শব্দটি ব্যবহার করা হলেও, সেই স্বচ্ছতার প্রকৃত অর্থ ছিল—জনগণকে অন্ধকারে রেখে কাগজে-কলমে বৈধতার ছাপ লাগানো।
বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টরসহ আরও অনেক আন্তর্জাতিক পরামর্শক এই চুক্তি সম্পাদনের পক্ষে চাপ বাড়াতে থাকেন। এই চাপে যোগ দেয় অভ্যন্তরীণ আমলাতন্ত্রের একটা অংশ, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা, ব্যবসায়ী মহলের কিছু গোষ্ঠী। এরই মধ্যে বন্দরের শ্রমিক, বন্দর–সংলগ্ন মানুষ আর দেশের সাধারণ নাগরিকদের একটি অংশ এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করেন। ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’সহ নাগরিক সমাজের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম দীর্ঘমেয়াদি বন্দর ইজারার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত লংমার্চ হয়, জনমত তৈরির নানা কর্মসূচি হয়, গণমাধ্যমে বিতর্ক শুরু হয়। আদালতেই গড়ে ওঠে আরেকটি প্রতিরোধের মঞ্চ; বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। আইনজীবীরা আদালতে দেখাতে সক্ষম হন, পুরো প্রকল্পটির পেছনে ছিল জালিয়াতি, মূল কোম্পানির ছদ্মনামে নতুন কোম্পানি গড়ে বন্দর চুক্তির নামে বিপুল ঋণ তোলার পাঁয়তারা হয়েছিল। আদালতের রায় আর জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত সেই দীর্ঘমেয়াদি ইজারা পরিকল্পনা বাতিল হয়।
এই অভিজ্ঞতার পরও আজ আবারও প্রায় একই কায়দায় বিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ইজারা দেওয়ার চেষ্টায় ফেরত আসা—এ যেন অতীত থেকে কোনো শিক্ষা না নেওয়ার এক স্পষ্ট উদাহরণ। এবার যুক্তরাষ্ট্রের বদলে সামনে এসেছে আরেক রাষ্ট্রীয় কোম্পানি—ডিপি ওয়ার্ল্ড। প্রতিষ্ঠানটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হলেও, বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের আচরণ দেখে মনে হয় যেন নিজেদের বন্দর পরিচালনার সক্ষমতা নিয়ে তাদের আস্থাই নেই। অথচ সিঙ্গাপুরের কথা বারবার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশকে নাকি “সিঙ্গাপুর বানাতে” হলে বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্দর পরিচালনা ছেড়ে দিতে হবে। সমস্যাটা এখানেই—সিঙ্গাপুরের বাস্তবতা আর বাংলাদেশের বাস্তবতা এক নয়, কিন্তু উদাহরণ টেনে আনা হয় একচোখা তুলনার ভিত্তিতে।
সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি বহুলাংশে নির্ভর করে কাঁচামাল আমদানি, প্রক্রিয়াজাত শিল্প এবং ট্রান্সশিপমেন্ট বাণিজ্যের ওপর। তাদের বন্দরের বেশির ভাগ কাজই এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য–কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকে ঘিরে। তবে সিঙ্গাপুরের বন্দরের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ মূলত রাষ্ট্রের হাতে। পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি নামের রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি বন্দর পরিচালনা করে, পরে বাণিজ্যিকভাবে আরও কার্যকর করতে এটিকে করপোরেট কাঠামোতে রূপ দেওয়া হয়। আবার মেরিটাইম অ্যান্ড পোর্ট অথরিটি নামে আরেকটি সংস্থা নীতি, তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের অংশ সামলায়। নানা সংস্কার সত্ত্বেও, সিঙ্গাপুর কোনো কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির হাতে হস্তান্তর করেনি। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোও সেখানে বেশ সক্রিয়, রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানের বাইরে কৌশলগত স্থাপনা বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনি। বরং উল্টো দিক থেকে সিঙ্গাপুর নিজেই অন্য দেশের বন্দরে বিনিয়োগ করছে, পরিচালনায় অংশ নিচ্ছে।
অর্থাৎ সিঙ্গাপুরের উন্নয়নের গল্প আসলে নিজের বন্দরকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে রেখে, দক্ষতা আর স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করে, বিশ্ববাণিজ্যে নিজস্ব অবস্থান শক্ত করার গল্প। সেটি কখনোই নয় যে, প্রধান বন্দরকে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ‘সিঙ্গাপুর হওয়ার’ কাহিনি বলা হয় ঠিক বিপরীত ব্যাখ্যায়—যেন নিজেদের বন্দর পরিচালনা করতে পারা মানেই অনুন্নয়নের লক্ষণ, তাই দ্রুত বিদেশি ব্যবস্থাপনা ডাকতে হবে।
বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর দুইটি—চট্টগ্রাম ও মোংলা—কেবল বাণিজ্যিক নয়, কৌশলগত দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার, দুই প্রান্তে নদীসংযোগ, আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথের সন্নিকটে অবস্থান—সব মিলিয়ে এগুলো দেশের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ জ্বালানি-সম্পদ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের বিপুল সম্ভাবনার কথা বারবার গবেষণায় উঠে এসেছে। এর সবকিছুই মিলিয়ে সমুদ্রসীমা ও বন্দর শুধু আজকের বাণিজ্য নয়, আগামী দিনের জ্বালানি নিরাপত্তা, সামুদ্রিক অর্থনীতি ও ভূরাজনীতিরও ভিত্তি।
এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে, বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্দরের পরিচালনা, টার্মিনালের ইজারা কিংবা নজরদারির গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে দেওয়ার অর্থ দাঁড়ায় নিরাপত্তার কিছু দরজা অনিবার্যভাবেই বাইরের শক্তির হাতে তুলে দেওয়া। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের এক ছোট অর্থনীতি হয়তো, কিন্তু তার ভৌগোলিক অবস্থান অনেক বড় শক্তির নজরের কেন্দ্রে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত—প্রত্যেকেই নিজেদের কৌশলগত স্বার্থের জায়গা থেকে বঙ্গোপসাগরকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সামরিক মহড়া, ‘নিরাপত্তা সহযোগিতা’, বন্দরের আশপাশে অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা প্রস্তাব নিয়ে এই শক্তিগুলোর প্রতিনিধি প্রায়ই ঢাকায় আসছেন। তাদের ভাষায় এসব উদ্যোগ নাকি “সমুদ্র নিরাপত্তা” জোরদারের জন্য; কিন্তু আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বারবার দেখিয়েছে, এমন নিরাপত্তা উদ্যোগ অনেক দেশে দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরতা, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন বা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের পথ খুলে দিয়েছে।
এই বাস্তবতায় চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দরের মতো প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা, বিদেশি ব্যবস্থাপনা বা অস্বচ্ছ চুক্তি দেশকে আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় আসা-যাওয়ার পরও বন্দর ইজারার প্রতি আগ্রহে খুব যে পরিবর্তন এসেছে, তা নয়; বরং এই আগ্রহের ধারাবাহিকতা ইঙ্গিত করে, রাষ্ট্রের একাংশে যেন একটা স্থায়ী চিন্তাধারা তৈরি হয়ে গেছে—নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর বদলে, সমাধান খুঁজতে হবে বাইরের কোম্পানি আর পরামর্শকের কাছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কমিশনভোগী, দালালচক্র ও লুম্পেন মানসিকতার কিছু অংশ, যারা জাতীয় কৌশলগত স্বার্থের চেয়ে তাত্ক্ষণিক আর্থিক লাভের দিকে বেশি তাকায়।
এই প্রেক্ষাপটে সামনে যে পথটি জরুরি বলে মনে হয়, তা হলো উল্টো দিকের পথ—জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির পথ। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কৌশলগত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিয়ে, সেগুলোর অবকাঠামো, প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা ও শ্রমশক্তিকে আধুনিক করে, আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার কাজটিই হওয়া উচিত অগ্রাধিকার। এর অর্থ, দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, দুর্নীতি ও অদক্ষতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, শ্রমিক ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো, ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সময়-খরচ কমিয়ে আনা। এগুলো করা গেলে বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভর না করেই বন্দরকে আঞ্চলিক হাবে উন্নীত করা সম্ভব।
কিন্তু এই পথে বাধা অনেক। কমিশন সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা ও দালালদের কাছে এই পথ আকর্ষণীয় নয়, কারণ এখানে এককালীন বড় অঙ্কের ‘ডিল’ নেই, দীর্ঘমেয়াদি ধীরে ধীরে অর্জিত উন্নতি আছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে চাওয়া শক্তিগুলোর জন্যও সুবিধাজনক হয় যখন একটি দেশের কৌশলগত স্থাপনায় বিদেশি কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়। ফলে একটি অংশ হয়তো এই ইজারা-নির্ভর মডেলের দিকে ঠেলে দিতে থাকবে। অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার—এসবের কথা মাথায় রাখলে স্পষ্ট হয়, বন্দর ইজারার বদলে রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বাড়ানোর পথই একমাত্র টেকসই বিকল্প।
এখন প্রশ্ন, এই পথ তৈরি করবে কে? উত্তরটি অস্বস্তিকর হলেও স্পষ্ট—সরকারি কাঠামোয় যারা কমিশনভিত্তিক চিন্তায় অভ্যস্ত, তারা নিজেরা থেকে এই পথ বেছে নেবে না। কাজটি করতে হবে জনগণকে, নাগরিক সমাজকে, শ্রমিক সংগঠনকে, পেশাজীবী মহলকে, দেশের সচেতন অংশকে। অতীতে যেমন চট্টগ্রাম বন্দর ইজারার বিরুদ্ধে জনমত ও আদালতের লড়াই এক পৃথিবীসম জালিয়াতি চুক্তিকে থামিয়ে দিয়েছিল, তেমনি আজও দরকার সমুদ্রবন্দরকে জাতীয় অধিকার ও নিরাপত্তার প্রশ্ন হিসেবে সামনে আনা। রাষ্ট্রের উন্নয়ন মানে যেন কখনোই না হয় নিজের ঘরের চাবি অন্যের হাতে তুলে দেওয়া; বরং উন্নয়ন মানে হোক নিজের ঘরকে এমনভাবে গুছিয়ে তোলা, যাতে দরজার বাইরে দাঁড়ানো যে–কোনো শক্তিও বুঝে—এই ঘরের মালিকানা, নিয়ন্ত্রণ ও ভবিষ্যৎ কৌশল ঠিক করার অধিকার কেবল এই দেশের মানুষেরই।
আপনার মতামত জানানঃ