
যুদ্ধবিরতি বললে সাধারণত আমরা শান্তির একটা ছবি কল্পনা করি—যেখানে বোমা-গোলার শব্দ থেমে যায়, মানুষ ঘরে ফিরে আসে, শিশুরা আবার স্কুলে যায়। কিন্তু গাজায় সেই ছবিটা এখনও দেখা যায়নি। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও ইসরাইলের হামলায় নিহত হয়েছে প্রায় ৯৭ জন ফিলিস্তিনি, আহত দুই শতাধিক। গাজার স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, ইসরাইল অন্তত ৮০ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। ইসরাইলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, হামাসই নাকি প্রথম আক্রমণ করেছে, আর তাদের প্রতিক্রিয়ায় বিমান হামলা চালানো হয়েছে। তবে হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে যাতে পরিস্থিতি শান্ত থাকে। কিন্তু মাটির বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন কথা বলছে।
গাজা শহরের রাস্তা, বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল—সবকিছু আজ এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাড়ি হারানো পরিবারগুলো আশ্রয় নিয়েছে অস্থায়ী ক্যাম্পে, যেখানে খাবার, পানি বা চিকিৎসা কিছুই পর্যাপ্ত নয়। শিশুদের মুখে আতঙ্কের ছাপ। অনেকেই এখনও বুঝে উঠতে পারছে না কেন তাদের জীবনে এমন দুর্ভাগ্য নেমে এলো। মায়ের কোলে সন্তান মৃত, স্বামীর দেহ ফিরে আসছে না, বা বোন হারিয়েছে ভাইকে—এমন অসংখ্য হৃদয়বিদারক গল্পে ভরা গাজার প্রতিটি গলি।
সম্প্রতি এক হামলায় একই পরিবারের ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে ছিল শিশু, নারী, বৃদ্ধ—কারও কোনো অপরাধ ছিল না। মানবাধিকার সংস্থা প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস বলেছে, এসব হামলা কোনো সামরিক প্রয়োজন নয়, বরং এটা ধারাবাহিকভাবে বেসামরিক মানুষকে টার্গেট করার এক নীতি। গাজার মানুষ বলছে, যুদ্ধবিরতির পরও প্রতিদিনই তাদের ঘুম ভাঙে বিস্ফোরণের শব্দে। রাত নামলেই আকাশে ড্রোনের গুঞ্জন, শিশুরা কাঁদে, মায়েরা চোখের পানি চেপে রাখে।
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা গাজার কিছু অংশে গিয়ে যা দেখেছেন, তাতে তারা বলেছেন—“পুরো শহরটা যেন মরুভূমি হয়ে গেছে।” চারপাশে ধুলো, ভাঙা বাড়ি, পোড়া গাড়ি আর ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছুই নেই। মানবিক সহায়তা পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু সীমান্তে বাধার কারণে তা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ, বিদ্যুৎ—সবকিছুর তীব্র সংকট। হাসপাতালগুলো আর কার্যকর নেই; অনেক চিকিৎসক নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন, কিন্তু তাদের হাতে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই।
শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকে স্কুলে যেতে পারছে না, কারণ স্কুল ভবন নেই। যারা বেঁচে আছে, তারা ভয়ে ঘুমাতে পারে না। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, গাজার প্রজন্ম এক গভীর মানসিক আঘাত নিয়ে বড় হচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে দিতে পারে। প্রতিদিন তারা দেখছে মৃত্যু, রক্ত, ভয় আর ক্ষুধা। এক মায়ের কথায়—“আমার ছেলে এখন আর হাসে না। আকাশে বিমান দেখলেই কাঁদতে শুরু করে।”
রাজনৈতিকভাবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এলেও বাস্তবে শান্তির কোনো ছোঁয়া নেই। ইসরাইল বলছে, তারা আত্মরক্ষার জন্য হামলা চালাচ্ছে। হামাস বলছে, তারা চুক্তি মেনে চলছে। সত্যিটা হয়তো মাঝখানে কোথাও আটকে আছে, কিন্তু তার জন্য মরছে সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ উভয়ই উদ্বেগ জানিয়েছে, তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর আছে, কিন্তু গাজায় বোমা পড়ার শব্দে তা বোঝা যায় না।
অর্থনৈতিকভাবেও গাজা এখন প্রায় অচল। বাজার বন্ধ, কৃষিক্ষেত্র ধ্বংস, জেলেরা সমুদ্রে যেতে পারছে না। কাজ হারানো মানুষ এখন মানবিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করছে। অনেক পরিবার দিনে একবেলা খেয়ে বেঁচে আছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতারা সাহায্য পাঠালেও সেটি যথেষ্ট নয়। সীমান্তে চেকপয়েন্টে ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রাক আটকে থাকে, ফলে খাদ্যদ্রব্য নষ্ট হয়ে যায়। গাজা এখন যেন এক খোলা কারাগার, যেখানে মানুষ বেঁচে আছে কিন্তু স্বাধীন নয়।
অন্যদিকে, পশ্চিম তীরেও উত্তেজনা বাড়ছে। ইসরাইল সেখানে প্রায় ৭০ একর ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। তারা মনে করছে, যুদ্ধবিরতি শুধু গাজার জন্য নয়—সারা অঞ্চলের জন্যই এক প্রতারণা। অনেকেই বলছে, যতদিন পর্যন্ত দখলনীতি আর অবরোধ বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি কাগজেই থাকবে।
বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষ গাজার প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছে। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার অনেক দেশে প্রতিবাদ মিছিল হচ্ছে। শ্রমিক ইউনিয়ন, মানবাধিকার সংগঠন, শিক্ষার্থী—সবাই এক কণ্ঠে বলছে, “ফিলিস্তিনে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করো।” এমনকি মার্কিন শ্রম আন্দোলনের নেতা ক্রিস স্মলসও গাজার মানুষের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন। তার মতে, “মানুষের অধিকার কোনো রাজনীতির বিষয় নয়, এটা মানবতার প্রশ্ন।”
এই সময় গাজায় একমাত্র আলো ছড়াচ্ছে মানবিক সহায়তার দলগুলো। আন্তর্জাতিক রেডক্রস, ডব্লিউএফপি, আর জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা রাতদিন কাজ করছে। তবে তাদের সদস্যরাও ঝুঁকির মধ্যে আছে। অনেক ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন। তারপরও তারা হাল ছাড়েননি। কেউ বলছেন, “আমরা না থাকলে এই মানুষগুলো বাঁচবে কীভাবে?” তাদের ত্যাগ ও সাহস আজ গাজার ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।
সবশেষে প্রশ্ন আসে—এই যুদ্ধবিরতির আসল অর্থ কী? যদি যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ৯৭ জন মানুষ মারা যায়, শত শত আহত হয়, শিশু অনাথ হয়, পরিবার হারায় সবকিছু, তবে এই চুক্তির মূল্য কোথায়? শান্তি যদি কেবল রাজনীতির আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে, আর মাঠে শুধু রক্ত ঝরে, তবে ইতিহাস একদিন এই যুদ্ধবিরতিকে এক ভণ্ড প্রতিশ্রুতি হিসেবেই মনে রাখবে।
গাজার মানুষ আজ শুধু শান্তি চায়—একটু নিরাপদ ঘর, শিশুর মুখে হাসি, আর ভয়ের মুক্ত একটা রাত। তারা কোনো রাজনৈতিক হিসাব চায় না, কোনো ক্ষমতার খেলা বোঝে না। তারা শুধু বাঁচতে চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, যুদ্ধবিরতির পরও সেই সাধারণ স্বপ্নটুকু তাদের কাছে যেন আরও দূরে সরে যাচ্ছে। গাজা এখন এমন এক ভূমি, যেখানে জীবনের প্রতিটি নিশ্বাসও যুদ্ধের মতো কঠিন হয়ে উঠেছে।
আপনার মতামত জানানঃ