বিরিয়ানির ইতিহাস কেবল একটি রান্নার কাহিনি নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং বহিরাগত প্রভাবের এক দীর্ঘ বিবর্তনের সাক্ষ্য। আজকে যে খাবারটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এবং অভিজাত থেকে সাধারণ মানুষের টেবিলে সমানভাবে স্থান করে নিয়েছে, সেটির শেকড় খুঁজতে গেলে পৌঁছাতে হয় মুঘল দরবার থেকে বহু দূরের অতীতে, বৈদিক যুগ এবং দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন রন্ধনশৈলীতে। বিরিয়ানির জন্ম, বিকাশ এবং বৈচিত্র্য এ অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ষোড়শ শতকে মুঘলদের সঙ্গে ভারতে প্রবেশ করা ফারসি শব্দ “বিরিয়ান” বা “বিরিঞ্জ” থেকেই বিরিয়ানির নামের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। “বিরিয়ান” অর্থ ভাজা বা রোস্ট করা, আর “বিরিঞ্জ” অর্থ ভাত। মুঘলরা পারস্য থেকে আসা পোলাওকে ভারতীয় মসলা, ঘি এবং স্থানীয় উপকরণের সঙ্গে মিশিয়ে নতুন এক পদে রূপ দিলেন, যা ধীরে ধীরে বিরিয়ানিতে পরিণত হলো। সম্রাট আকবরের দরবারের প্রশাসনিক দলিল আইন-ই-আকবরি-তে বিভিন্ন ধরনের মাংস ও ভাতের পদ উল্লেখ করা আছে। তবে সেখানে যে “বিরিয়ান” উল্লেখ আছে তা ভাত ছাড়াই রান্না করা হতো। অর্থাৎ আধুনিক বিরিয়ানির সঙ্গে এর মিল থাকলেও, তখনকার দিনে মাংস-ভাতের মিশ্রিত পদগুলোকে আলাদাভাবে পলাও, কুবুলি কিংবা শুল্লাহ নামে ডাকা হতো।
এই সময়কার রান্নার পদ্ধতি ছিল বিশেষভাবে “দম পুখত”, যার অর্থ ধীরে ধীরে কম আঁচে রান্না করা। মাটির বা ধাতব পাত্রে উপকরণ সাজিয়ে মুখ শক্তভাবে আটকে দেওয়া হতো, যেন ভেতরের বাষ্প বের হতে না পারে। এই প্রক্রিয়ায় ভাত ও মাংসের প্রতিটি দানা আলাদা হয়ে সুগন্ধি ও রসে ভরে উঠত। পারসিদের হাত ধরে জাফরান ব্যবহারের প্রচলন বাড়ে, যা খাবারে এক রাজকীয় সুগন্ধ যোগ করত। দইও বিরিয়ানির এক বিশেষ উপাদান হয়ে ওঠে, যা খাবারকে কোমলতা ও টক-মিষ্টি স্বাদ দিত।
তবে বিরিয়ানির ইতিহাস শুধু মুঘল যুগেই সীমাবদ্ধ নয়। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের উপনিষদে ভাত ও ষাঁড়ের মাংস ঘি দিয়ে রান্নার উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাকাব্য রামায়ণ-এও ‘মামসৌদনা’ নামে মাংস ও চালের একটি পদ রান্নার বর্ণনা আছে। দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন সাহিত্যেও এই ধরনের পদের প্রমাণ মেলে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের তামিল কবিরা লিখেছেন “উন সুরু” নামে এক পদ সম্পর্কে, যার অর্থই হলো মাংস ভাত। এটি মূলত সৈন্যদের খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত করা হতো। ১২ শতকের রান্নার গ্রন্থ পাকদর্পণম-এ বিভিন্ন মাংস, চাল, ঘি, নারকেলের দুধ ও মসলা দিয়ে রান্না করা পদের উল্লেখ আছে, যা আধুনিক বিরিয়ানির সঙ্গে আশ্চর্য রকম মিল রাখে।
মুঘল সাম্রাজ্যের শুরুতে বাবর স্থানীয় বাবুর্চিদের ব্যবহার করলেও, একবার বিষপ্রয়োগের ঘটনার পর তিনি কাবুল থেকে বাবুর্চি আনতে শুরু করেন। এরা মূলত পারসি রন্ধনশৈলীতে পারদর্শী ছিলেন। তাদের হাত ধরেই বিরিয়ানিতে জাফরান, দই, শুকনো ফল ইত্যাদি ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ মহল নাকি সৈন্যদের জন্য পুষ্টিকর খাবার হিসেবে বিরিয়ানির সৃষ্টি করেছিলেন—এই লোককথাটি খুব প্রচলিত হলেও ইতিহাসবিদরা একে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না। তবে এতে প্রমাণিত হয় যে মুঘল আমলে বিরিয়ানি রাজকীয় মর্যাদা পেয়েছিল।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর আঞ্চলিক রাজবংশগুলো নিজেদের স্বাদ ও উপকরণের সঙ্গে বিরিয়ানিকে মানিয়ে নেয়। ফলে জন্ম নেয় হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি, যেখানে প্রচুর মসলা, ভাজা পেঁয়াজ ও টক দই ব্যবহৃত হয়। আওধি বা লক্ষ্ণৌই বিরিয়ানি তুলনামূলক হালকা মসলা দিয়ে তৈরি হয়, এতে সুগন্ধি মসলা ও কেশরের ব্যবহার বেশি থাকে। কলকাতার বিরিয়ানিতে আলুর সংযোজন একে আলাদা করেছে, যা নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের সঙ্গে যুক্ত এক বিশেষ ইতিহাস বহন করে। আবার দক্ষিণ ভারতের মালাবার বিরিয়ানিতে নারকেলের দুধ ও স্থানীয় মসলা ব্যবহারের কারণে স্বাদে ভিন্নতা দেখা যায়।
বিরিয়ানির সংজ্ঞা দেওয়া আজ খুবই কঠিন, কারণ অঞ্চলভেদে এর উপাদান, রান্নার ধরণ ও পরিবেশনের ধরন আলাদা। কোথাও মাটন, চিকেন বা গরুর মাংস ব্যবহার হয়, কোথাও মাছ, চিংড়ি এমনকি নিরামিষ উপকরণও দেখা যায়। কলকাতার বিরিয়ানিতে যেমন আলু একটি অপরিহার্য অংশ, তেমনি কিছু অঞ্চলে কিশমিশ বা বাদামের ব্যবহার একে আলাদা স্বাদ দেয়।
বিরিয়ানির সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশে আরও কিছু পদ সমান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কাবাবের ইতিহাস যেমন মধ্য এশিয়া ও পারস্যে, তেমনি ভারতে এসে তা এক নতুন রূপ পায়। আওধ অঞ্চলে বাবুর্চিরা মাংসকে নরম করতে কাঁচা পেঁপে ব্যবহার করে গলৌটি কাবাব তৈরি করেন, যা মুখে দিলেই গলে যায়। আবার শিক কাবাব, শামি কাবাব, রেশমি কাবাব সবই স্থানীয় সৃজনশীলতার নিদর্শন।
একইভাবে পোলাওয়ের ইতিহাসও বিরিয়ানির সঙ্গে জড়িত। পোলাও তুলনামূলক কম মসলা দিয়ে রান্না করা হয় এবং চাল ও মাংস একসঙ্গে সেদ্ধ হয়। ইয়াখনি পোলাও, কাবুলি পোলাও প্রভৃতি ছিল মুঘল দরবারে জনপ্রিয়। বিরিয়ানির তুলনায় পোলাও হালকা স্বাদের হলেও দুই পদই দক্ষিণ এশীয় রন্ধনশৈলীতে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তন্দুর ও নানকেও ভুলে যাওয়া যায় না। তন্দুর নামের মাটির উনুন মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে আসে, এবং মুঘল আমলে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। ফারসি শব্দ “নান” অর্থ রুটি, যা তন্দুরে বানানো হতো এবং রাজকীয় ভোজে কাবাব বা কিমার সঙ্গে পরিবেশন করা হতো। এই তন্দুর থেকেই পরে জন্ম হয় বিখ্যাত তন্দুরি চিকেনের।
আজকের দিনে বিরিয়ানি দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকার রেস্তোরাঁয়ও এটি পাওয়া যায়। তবে প্রতিটি জায়গায় স্থানীয় রুচি অনুযায়ী এতে পরিবর্তন এসেছে। কোথাও এটি মসলায় ঝাল, কোথাও তুলনামূলক হালকা।
বিরিয়ানির এই দীর্ঘ ইতিহাস প্রমাণ করে খাবার শুধু পেট ভরানোর উপকরণ নয়, বরং এটি সংস্কৃতি ও সভ্যতার মিলনস্থল। পারসিদের জাফরান, দক্ষিণ ভারতের নারকেলের দুধ, বাংলার আলু, আওধের কোমল কাবাব—সবই বিরিয়ানির ভেতরে মিশে আছে। প্রতিটি অঞ্চল নিজেদের মতো করে একে সাজিয়েছে, তবে সবগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অনন্য ঐতিহ্য।
আজ বিরিয়ানি কেবল একটি খাবার নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার পরিচয়ের প্রতীক। রাজকীয় দরবার থেকে শুরু করে রাস্তার দোকান, পারিবারিক আয়োজন থেকে আন্তর্জাতিক রেস্তোরাঁ—বিরিয়ানি সর্বত্র তার জায়গা দখল করেছে। এই পদটি শুধু রন্ধনশৈলীর নয়, বরং ঐতিহাসিক যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং সময়ের সঙ্গে অভিযোজনের এক অনন্য দলিল।
আপনার মতামত জানানঃ