মানুষের কল্পনা আর বিজ্ঞানের মিলনেই জন্ম নেয় নতুন নতুন বিস্ময়কর আবিষ্কার। বহুদিন ধরে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন এমন কিছু তৈরি করতে, যা একদিকে মানুষের জীবনকে সহজ করবে, অন্যদিকে প্রকৃতিকে ব্যবহার করবে আরও সুন্দরভাবে। আলো মানুষের জীবনের একটি মৌলিক চাহিদা। রাতকে আলোকিত করার জন্য আমরা ব্যবহার করি বিদ্যুতের বাতি, ল্যাম্পপোস্ট কিংবা বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম আলোকব্যবস্থা। কিন্তু কেমন হবে যদি একদিন দেখা যায়, বিদ্যুতের বাতির বদলে গাছপালা আমাদের চারপাশকে আলোকিত করছে? হয়তো শুনতে পুরোপুরি সায়েন্স ফিকশনের মতো লাগছে, কিন্তু চীনা বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই এমন এক আবিষ্কার করেছেন যা এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। তারা এমন এক ধরনের গাছ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যেগুলো অন্ধকারে আলো ছড়ায়।
এই গবেষণার অন্যতম সহ-লেখক শুটিং লিউ জানিয়েছেন, তাদের ইচ্ছা ছিল জনপ্রিয় সিনেমা ‘অ্যাভাটার’-এর মতো একটি পরিবেশ তৈরি করা। আমরা যারা সিনেমাটি দেখেছি, তারা জানি সেখানে রাতের বেলায় বন জঙ্গলে গাছপালা, ফুল, লতাগুল্ম এমনভাবে আলোকিত হয় যে মনে হয় পুরো প্রকৃতিই একটি বিশাল প্রদীপ। লিউ এবং তার দল চাইছিলেন সেই সিনেমার দৃশ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে। তাদের স্বপ্ন ছিল এমন এক শহর গড়ে তোলা, যেখানে রাস্তায় আলোর উৎস হবে গাছপালা, শুধু সাজসজ্জা নয় বরং কার্যকর আলোকব্যবস্থা হিসেবেই গাছ ব্যবহার হবে।
সাধারণত গাছকে আলোকিত করার জন্য বিজ্ঞানীরা জেনেটিক এডিটিং ব্যবহার করে থাকেন। সেই প্রক্রিয়ায় গাছ থেকে কেবল সবুজ আলো পাওয়া যায়। কিন্তু এই দলটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। তারা ইচেভেরিয়া ‘মেবিনা’ নামের একটি গাছের পাতায় স্ট্রন্টিয়াম অ্যালুমিনেট নামের বিশেষ এক উপাদান ইনজেক্ট করেছেন। এই উপাদান সাধারণত খেলনা, ঘড়ি বা অন্য জিনিসে ব্যবহার করা হয় যা অল্প আলো শোষণ করে পরে ধীরে ধীরে তা নির্গত করে। নতুন এই পদ্ধতিতে গাছ থেকে শুধু সবুজ নয়, বরং লাল, নীল এবং সবুজ—তিন ধরনের আলোই পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এর ফলে গাছগুলো দেখতে হয়ে উঠেছে আরও মোহনীয় এবং ব্যবহারিক দিক থেকেও কার্যকর।
গবেষণার ফল প্রমাণ করতে তারা একটি সবুজ দেয়াল তৈরি করেছিলেন, যেখানে মোট ৫৬টি গাছ লাগানো হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই গাছগুলো এতটাই উজ্জ্বল আলো দিচ্ছিল যে মাত্র ১০ সেন্টিমিটার দূর থেকেও সহজেই যেকোনো লেখা, ছবি কিংবা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছিল। মাত্র কয়েক মিনিট সূর্যের আলোতে রাখলেই গাছগুলো টানা দুই ঘণ্টা উজ্জ্বল থাকতে পারে। আলো কমে গেলে আবার সূর্যের আলোতে চার্জ হয়ে ওঠে। একবার উপাদান ইনজেক্ট করার পর গাছগুলো প্রায় ২৫ দিন ধরে আলো ছড়াতে পারে। শুধু তাই নয়, এমনকি শুকনো পাতাও যদি অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে আসে তাহলে সেগুলোও আলোকিত হয়ে ওঠে।
তবে যেকোনো নতুন আবিষ্কারের মতো এখানেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। উপাদানটি গাছের টিস্যুর ক্ষতি করতে পারে, ফলে গাছের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এ সমস্যা কাটানোর জন্য গবেষকরা একটি বিশেষ রাসায়নিক আবরণ তৈরি করেছেন, যা গাছের টিস্যুকে সুরক্ষা দেয়। তারপরও বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন যে এখনো গাছগুলো যথেষ্ট উজ্জ্বল নয়, যাতে ল্যাম্পপোস্টের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তাই আপাতত এগুলোকে সাজসজ্জা বা রাতের বাতি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
গবেষকরা বিশ্বাস করেন, সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তি আরও উন্নত হলে একদিন এই গাছগুলো সত্যিই টেকসই আলোকব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে। কল্পনা করা যায়, যদি শহরের রাস্তাগুলোতে ল্যাম্পপোস্টের পরিবর্তে আলো ছড়ায় গাছ, তাহলে বিদ্যুতের ব্যবহার অনেকটা কমে আসবে। এতে পরিবেশও বাঁচবে, একইসাথে সৌন্দর্যও বাড়বে। বর্তমানে আমরা জলবায়ু পরিবর্তন, বিদ্যুতের অপচয় এবং পরিবেশ দূষণের মতো সমস্যার মুখোমুখি। এমন এক পৃথিবীতে আলোকিত গাছ নিঃসন্দেহে এক টেকসই সমাধান হিসেবে কাজ করতে পারে।
তবে সবাই এই গবেষণাকে এখনই বাস্তবসম্মত মনে করছেন না। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন কার মনে করেন, প্রযুক্তিটি এখনও পরিপক্ব হয়নি। তার মতে, সীমিত আলো উৎপাদনের কারণে এটি নিকট ভবিষ্যতে ল্যাম্পপোস্টের বিকল্প হতে পারবে না। তবে তিনি এটিও বলেছেন যে, গবেষণাটি নিঃসন্দেহে চমৎকার এবং ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনাময়।
শুটিং লিউ নিজেও স্বীকার করেছেন যে তাদের আবিষ্কার এখনও প্রাথমিক স্তরে আছে। কিন্তু এর মধ্যেই সারা বিশ্বে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এটি ভবিষ্যতের শহর পরিকল্পনার জন্য একটি বিপ্লবী ধারণা। কল্পনা করুন, বড় শহরের পার্ক, রাস্তা বা ফুটপাতগুলোতে যদি এমন আলোকিত গাছ ব্যবহার করা হয়, তবে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা কতটা কমে যাবে। এমনকি গ্রামের অন্ধকার রাতগুলোতেও যদি এই গাছ লাগানো হয়, তবে বিদ্যুৎবিহীন এলাকাগুলোও আলোকিত হয়ে উঠতে পারে।
আরও একটি বড় দিক হলো, এটি শুধু আলোকব্যবস্থাই নয়, মানুষের মানসিক আনন্দও বাড়াবে। প্রাকৃতিক আলো সবসময় মানুষের মনে প্রশান্তি আনে। কৃত্রিম আলো চোখে চাপ ফেলে, কিন্তু গাছের আলো সেই চাপ অনেকটাই কমাতে পারে। ফলে এটি শুধু বিদ্যুৎ সাশ্রয় করবে না, বরং মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
অবশ্য এখনো অনেক গবেষণা বাকি। গাছগুলো কতদিন বেঁচে থাকতে পারবে, কতটা আলো দিতে পারবে এবং দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশে কোনো ক্ষতি করবে কিনা—এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী, ধীরে ধীরে এসব সমস্যার সমাধান হবে। প্রতিটি বড় আবিষ্কারই শুরুতে সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, আলোকিত গাছ শুধু একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নয়, বরং এটি মানুষের কল্পনা ও স্বপ্নের বাস্তব রূপ। ‘অ্যাভাটার’-এর মতো সিনেমার কল্পনার জগতকে বিজ্ঞান বাস্তবে রূপ দিচ্ছে। হয়তো একদিন সত্যিই শহরের রাস্তায় আর ল্যাম্পপোস্ট থাকবে না, বরং সবদিকে আলো ছড়াবে গাছপালাই। বিজ্ঞানের সাথে প্রকৃতির এমন সুন্দর মেলবন্ধন মানবসভ্যতার জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করবে।
আপনার মতামত জানানঃ