বাংলাদেশে গত এক বছরে মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলার যে ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে, তা কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা নয় বরং এক গভীর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকটের প্রতিফলন। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার কবর থেকে মৃতদেহ তুলে এনে প্রকাশ্যে পোড়ানো তার একটি চরম উদাহরণ। কয়েক বছর আগেও এমন দৃশ্য কল্পনা করা যেত না। অথচ এখন ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পরিকল্পিতভাবে দফায় দফায় প্রচারণা চালিয়ে মব তৈরি করা হচ্ছে এবং প্রশাসন জানার পরও কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এটি আর আকস্মিক নয়, বরং পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত এক সহিংসতার রূপ নিয়েছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে অন্তত ৩৯০টি মবের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৯২ জন মানুষ এবং আহত হয়েছেন আরও কমপক্ষে ৩৭৬ জন। এ ধরনের পরিসংখ্যান বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে। মবের এমন প্রবণতা সমাজে ভীতি ছড়াচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আরও শক্ত করছে। ভুক্তভোগীদের পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আর অপরাধীরা প্রায়শই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পাওয়ায় আরও সাহসী হয়ে উঠছে।
এই ব্যর্থতার বড় কারণ হচ্ছে প্রশাসনের ভূমিকা। বিভিন্ন ঘটনার আগে সপ্তাহজুড়ে প্রচারণা চলে, জনতাকে উসকে তোলা হয়, অথচ পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন সেসব জানলেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা যায়। বরং মব আক্রমণের শিকার ব্যক্তিদেরই গ্রেফতার করার অভিযোগ ওঠে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে যারা মব তৈরি করে তারাই আরও সাহস পায় এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতিকে তারা স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে।
মানবাধিকার কর্মীরা এ পরিস্থিতিকে সরকার ও প্রশাসনের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সবসময় বলা হয় ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করা হবে, কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। সরকার শুধু নিন্দা বা আশ্বাসে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলে জামিন পাচ্ছে, আবার রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এর ফলে একটি বার্তা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে—মব গঠন করে সহিংসতা চালালেও তার প্রকৃত শাস্তি হবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, মব এখন বাংলাদেশের সমাজে এক ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্ত্র। ব্যক্তিগত শত্রুতা মেটানো থেকে শুরু করে স্থানীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় মবকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধর্মীয় আবেগকে উসকে দিয়ে মানুষকে জড়ো করা সহজ হওয়ায় এটি দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। যে সমাজে রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থা দুর্বল, সেখানে মব বিচার মানুষকে ভয় দেখানোর বা শাস্তি দেওয়ার কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ফলে দেশে ভীতি, অস্থিরতা ও নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ছে।
এই ব্যর্থতার দায় শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয়, সরকারের নীতিগত অবস্থানও প্রশ্নের মুখে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সরাতে আন্দোলন হলেও সরকার তাকে বহাল রেখেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি সরকারের ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন মত ও শক্তিকেন্দ্র থাকার ইঙ্গিত দেয়। অনেকেই বলছেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের নেতৃত্ব দিলেও তার উপদেষ্টাদের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। মানবাধিকারকর্মীরা এমনকি মন্তব্য করেছেন, এই সরকারের ভেতরে অনেক সরকার রয়েছে, এবং এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে।
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে প্রশাসনের কাঠামো ভেঙে পড়েছিল, স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধি নেই, তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন হয়ে উঠেছে। পুলিশের ওপর নৈতিক দুর্বলতাও তারা স্বীকার করছে। তবে তারা বলছে পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে একের পর এক মব সহিংসতার ঘটনা প্রমাণ করছে, সরকারের প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। জনমনে ভীতি ও অনাস্থা বাড়ছে, যা নির্বাচনের আগে আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে।
সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামানো হলেও সেটি স্থায়ী সমাধান নয়। দীর্ঘমেয়াদে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বেসামরিক প্রশাসনকেই দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু যেভাবে মবের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও অপরাধীরা দমে যাচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা এবং দুর্বল বিচারব্যবস্থার কারণে তারা আরও সংগঠিত হচ্ছে।
বিশ্লেষক আনু মুহাম্মদ বলছেন, যখন সরকার মবকে প্রেসার গ্রুপ বলে চিহ্নিত করে এবং অপরাধীদের ধরার বদলে ভুক্তভোগীদের গ্রেফতার করে, তখন অপরাধীদের আস্কারা দেওয়া হয়। এই নরম অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও নিয়ন্ত্রণহীন করছে। আরেকজন বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, সরকারের উপদেষ্টারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেও তাদের পরিবর্তন না করা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের প্রমাণ। এর ফলে জনমনে সন্দেহ জন্মাচ্ছে, সরকার আদৌ মব সহিংসতা বন্ধ করতে চায় কি না।
এই প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, মব বন্ধ করতে সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ প্রয়োজন। কঠোর শাস্তির নজির তৈরি না করলে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর মব ব্যবহারের প্রবণতা বন্ধ করতে না পারলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হবে। মব সহিংসতার বিস্তার কেবল আইনশৃঙ্খলার নয়, সমাজের নৈতিক অবক্ষয়েরও ইঙ্গিত বহন করছে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে ভীতি ও শঙ্কা রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে সহিংসতা আরও বেড়ে যেতে পারে। দেশের ভেতরে বহু শক্তিকেন্দ্র ও সরকারের দ্বিমুখী অবস্থান মব দমনে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে আস্থার সংকট, বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব মিলিয়ে বাংলাদেশে মব সহিংসতা এখন এক ভয়াবহ জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে।
তাই একদিকে মবের বিরুদ্ধে সরকারের ঘোষণায় শূন্য সহনশীলতার কথা বলা হলেও অন্যদিকে বাস্তবে মবকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থতা, অপরাধীদের আইনের আওতায় না আনা এবং ভুক্তভোগীদের উপরই দমননীতি প্রয়োগ—এসব মিলিয়ে জনমনে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। এর ফলে সমাজে আইনশৃঙ্খলার অবক্ষয় আরও গভীর হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে কেবল নির্বাচনের নিরাপত্তাই নয়, রাষ্ট্রের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাও প্রশ্নের মুখে পড়বে।
আপনার মতামত জানানঃ