ভারতের ৭২তম প্রজাতন্ত্র দিবসে রাজধানী দিল্লিতে বিক্ষোভরত কৃষকদের ট্রাক্টর মিছিল ঘিরে সহিংসতার পর ঐতিহ্যবাহী লাল কেল্লার নিরাপত্তা জোরদারে সেখানে শতাধিক পুলিশ মোতায়েন করে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডের পর নির্দিষ্ট কয়েকটি পথে আন্দোলনরত কৃষকদের রাজধানীতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কৃষকরা নির্ধারিত সময়ের আগেই এবং নির্দিষ্ট পথের বাইরে দিয়ে দিল্লিতে প্রবেশ করলে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ছুঁড়ে এবং লাঠিপেটা করে তাদের আটকাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কৃষকদের ট্রাক্টর মিছিল আটকানো যায়নি, উল্টো পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বেধে যায়।
দুই মাসের অবস্থান ধর্মঘটের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত দিনে একজন প্রতিবাদকারী নিহত এবং ৮০ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এদিকে প্রজাতন্ত্র দিবসে রাজধানী দিল্লিতে কৃষক বিক্ষোভে সহিংসতার ঘটনায় মোট ২২টি মামলা দায়ের করেছে ভারতের পুলিশ। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত দুইশ’ বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতারের কথা জানানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট এবং পুলিশ সদস্যদের হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশের দাবি, সহিংসতার ঘটনা যাচাই করে অভিযুক্তদের আটকের কাজ চলছে। ওই সহিংসতার পর দিল্লির অনেক সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নগরীতে বাড়তি পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি আধাসামরিক বাহিনীও টহল দিচ্ছে।
গত মঙ্গলবার তীব্র বিক্ষোভ প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনকে ছাপিয়ে গেছে। করোনাভাইরাস মহামারিজনিত কারণে আগেই বার্ষিক সামরিক প্যারেডসহ সব আয়োজন নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ কয়েকটি মেট্রো ট্রেন স্টেশন বন্ধ করে দেয় এবং বিক্ষোভ রোধে সরকারের বারবার কৌশল হিসাবে রাজধানীর কিছু অংশে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করা হয়েছিল। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যের শিখ-কৃষকরা নভেম্বর মাসে নয়াদিল্লিতে যাত্রা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পুলিশ তাদের থামিয়ে দেয়। তার পর থেকে তীব্র শীত এবং ঘন ঘন বৃষ্টিপাতের কারণে তারা শহরের প্রান্তে নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে এবং খামারের আইন বাতিল না করা হলে তারা অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড়।
নতুন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে মঙ্গলবারের বিক্ষোভ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে রূপ নেয়। দাঙ্গার বেশে থাকা পুলিশ সদস্যরা ১০ হাজারের বেশি ট্র্যাক্টরসহ পদব্রোজে আগত কৃষকদের টিয়ার গ্যাস ও পানিকামান যোগে হামলা চালিয়ে সরিয়ে দেয়। সতেরো শতকের দুর্গ মোগল সম্রাটের বাড়ীতে তাদের ঝড়োগতির প্রবেশ ভারতীয় নিউজ চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচার করে। স্মারক তলোয়ার, দড়ি এবং লাঠি নিয়ে কৃষকরা মোদির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী সরকারের জন্য গভীর প্রতীকী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে লাল কেল্লায় প্রবেশ করে ও গম্বুজের শীর্ষে শিখ ধর্মীয় পতাকা টানিয়ে দেয়।
প্রতিবাদী নেতা যোগেন্দ্র যাদব বলেন, ‘এটি নাশকতা হলেও আমরা দায়বদ্ধতা থেকে বাঁচতে পারি না’। মোদি সরকার যখন আগামী ১ ফেব্রুয়ারি সংসদে তার বার্ষিক বাজেট উপস্থাপন করবেন তখন আরেকটি মার্চের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাবেন কিনা সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। যাদব বলেন, প্রতিবাদী কৃষকদের মধ্যে হতাশা জেগে উঠেছে এবং তারা দুই মাস ধরে যে দাবি করে আসছেন সে বিষয়ে সরকার গুরুত্ব না দিলে আপনি কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করবেন’।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীরাজা চৌধুরী বলেন, কী হতে যাচ্ছে তা আঁচ করতে এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কৃষকরা যদি সমগ্র ভারতে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয় তবে কতিপয় বিরোধীর পক্ষ থেকে কৃষকদের উসকে দেয়ার অভিযোগ তুলে আপনি এ বিক্ষোভকে উপেক্ষা করতে পারবেন না’।
সরকার জোর দিয়ে বলেছে যে, সেপ্টেম্বরে সংসদে পাস হওয়া কৃষি আইন কৃষকদের উপকার করবে এবং বেসরকারী বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে তুলবে। তবে কৃষকরা আশঙ্কা করছেন যে, এটি কৃষি কর্পোরেট চালু করবে এবং তাদের পেছনে ফেলে দেবে। সরকার আইনটি ১৮ মাসের জন্য স্থগিত করার প্রস্তাব দিয়েছে, তবে কৃষকরা পুরো বাতিল হওয়ার চেয়ে কম কিছু চায় না।
এনডিটিভি জানায়, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর রাজধানীতে আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যে উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
‘সংযুক্ত কৃষাণ মোর্চা’ মঙ্গলবারের ওই সহিংস ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। কৃষকদের কয়েকটি সংগঠন মিলে এই মোর্চা গঠন করে এবং নতুন তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে এ বিক্ষোভের আয়োজন করেছে। বুধবার রাতের মোর্চার নেতাদের বৈঠক করার কথা রয়েছে। ওদিকে, পূর্বের রাজ্য ওড়িশা থেকে পশ্চিমের রাজ্য গুজরাটের কৃষক নেতারা দিল্লির এই বিক্ষোভে তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবেন বলে বুধবার জানিয়েছেন।
রাজস্থানের কৃষক নেতা রামান রান্ধাওয়া রয়টার্সকে বলেন, ‘‘আমরা আগেই পরিষ্কার করে বলেছি, আমরা ওই তিন কৃষি আইনের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চাই।সরকার ওই তিন আইন সম্পূর্ণ বাতিল না করা পর্যন্ত আমরা পিছু হটব না।”
এনডিটিভি জানায়, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের পার্লামেন্ট ভবন অভিমুখে কৃষকদের পদযাত্রার কর্মসূচি রয়েছে। যদিও মঙ্গলবারের সহিংস ঘটনার পর কৃষকদের ওই কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেওয়া হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এফএ/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ