করোনা মহামারির সময়েও চীনের অর্থনীতি ক্রমাগত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণাও জানিয়েছে, করোনা বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিকুলে থাকলেও অনুকুলে ছিল চীনের অর্থনীতি। গবেষকরা একইসাথে দাবি করেছেন, আগামী তিন চার বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছে চীন। এদিকে চীনকে কোণঠাসা করতেও প্রতিদ্বন্দ্বি দেশ আমেরিকাও কোনো কসরত বাকি রাখছে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন চীনকে কোণঠাসা করতে যেসব কৌশল অবলম্বন করেছেন, জানা যাচ্ছে, বাইডেনের প্রশাসন সেসব থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না। এরই প্রেক্ষিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে পরোক্ষ করে স্নায়ূযুদ্ধ না বাঁধানোর হুঁশিয়ারি করে দিয়েছে।
গত সোমবার ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের দাভোস সম্মেলনের ভার্চুয়াল ইভেন্টে বক্তব্য রাখার সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেরকে ‘শীতল যুদ্ধ’ মানসিকতা বাদ দিতে এবং বৈশ্বিক সমৃদ্ধির স্বার্থে বিভেদ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে হুঁশিয়ারি করে দেন। নির্দিষ্ট কোনো দেশ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বা এর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নাম উল্লেখ না করেই শীতল যুদ্ধের বিরুদ্ধে সতর্ক করেন তিনি।জিনপিং তার বক্তব্যে বলেন, নিজেদের মধ্যে ছোট জোট করলে, নতুন শীতল যুদ্ধ শুরু করলে, অন্যের মত প্রত্যাখ্যান করলে, কাউকে হুমকি দিলে বা ভয় দেখালে, ইচ্ছাকৃতভাবে অবরোধ আরোপ করলে, পণ্য সরবরাহে বাধা দিলে অথবা কাউকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে তা পৃথিবীকে বিভেদের দিকে ঠেলে দেবে। এমনকি সংঘাতের দিকেও ঠেলে দিতে পারে।
সুনির্দিষ্ট কারও নাম উচ্চারণ না করলেও জিনপিং এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন, বেইজিং কোনোভাবেই ওয়াশিংটনের নির্দেশ মোতাবেক চলবে না। তার স্পষ্ট বক্তব্য ‘কোনো বৈশ্বিক সমস্যা কোনো দেশ এককভাবে সমাধান করতে পারে না। সবার প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার মাধ্যমে তা সমাধান করতে হবে।’
ওই প্ল্যাটফর্মে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি নিজেকে বহুত্ববাদের রক্ষক দাবি করেন। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন অবশ্য এবারের দাভোস ফোরামে অংশগ্রহণ করেননি। সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ওই সভায় চিনপিং গত বছরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিগুলোই শুধু তুলে ধরেন। চার বছর আগে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করেন, সে সময়ও চিনপিং একইভাবে দাভোস ফোরামে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। চীনের ক্রমবর্ধমান অথনৈতিক প্রভাব কমাতে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই তৎপর। বাইডেন প্রশাসনও একই ধারা বজায় রাখবে বলে পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাস।
ওয়ার্ল্ড অর্থনৈতিক ফোরামের দাভোসের ভার্চুয়াল সম্মেলনে মহামারি বিষয়ে জিনপিং বলেন, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ না করলে মহামারি নির্মূল অসম্ভব। সেক্ষেত্রে চীনকে বর্জনের মাধ্যমে কেবল সংঘাতই বাড়বে। আমাদের সবাইকে নিঃসংকোচে মহামারি মোকাবিলায় অংশ নিতে হবে। সবাই যদি বর্জনের মন-মানসিকতা নিয়ে এগোই, তাহলে ‘নতুন স্নায়ুযুদ্ধ’ বেশি দূরে নয়। করোনাভাইরাস নির্মূলে সবাইকে জোটবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কারণ মানবিকতা না বাড়ালে হুমকি-হুঁশিয়ারি বা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে যে কোনো সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, জাপান এবং ভারতসহ চারটি দেশের একটি জোট ‘কোয়াড’ – এ অস্ট্রেলিয়ার ক্রমবর্ধমান ভূমিকার বিষয়েই জিনপিং এই মন্তব্য করেন। চীনের অর্থনৈতিক উত্থান বিশ্বব্যাপী মঞ্চে বেইজিংয়ের নীতি নিয়ে চিন্তিত ওই চার দেশ গত বছর ‘কোয়াড’কে কেন্দ্র করে পাস্পরিক সহযোগিতা আরও জোরালো করেছে।
নিজস্ব আধিপত্য অর্জনের পরিবর্তে বিশ্বকে আন্তর্জাতিক আইন এবং আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে জিনপিং বলেন, ‘চীন আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে মতবিরোধ সমাধানের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সাম্যতা এবং পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে অন্যান্য দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সমবায় সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে কঠোর প্রচেষ্টা করছে।’ তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনের শাসনকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে আমাদের দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে এবং জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আমাদের অবিচল থাকতে হবে।’
এদিকে বৃহৎ দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের মধ্যে লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) উত্তেজনা কমাতে দ্রুত মুখোমুখি অবস্থান থেকে সেনা পেছানোর বিষয়ে একমত হয়েছে দিল্লি ও বেইজিং। নবম দফার সামরিক স্তরের বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টি তুলে ধরা হয়। সিকিমের নাকু লা সীমান্তে ভারত ও চীনা সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের পরও শান্তির পক্ষের এই অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়, উত্তেজনা কমানোর লক্ষ্যে ধারাবাহিক আলোচনার পাশাপাশি দুপক্ষই মুখোমুখি অবস্থানকারী বাহিনীকে সংযত রাখার বিষয়ে একমত হয়েছে। সেনা সংখ্যা কমানোর বিষয়টি দশম দফার বৈঠকে আলোচনা হবে। এক্ষেত্রে উভয় দেশ একমত হলে সেনা কমানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং গত শনিবার বলেছিলেন, এলএসিতে মোতায়েন চীনা সেনার সংখ্যা কমানো না হলে ভারতও একতরফাভাবে সেনা কমাবে না। গত বছরের ১৫ জুন পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে সংঘর্ষের পরে দুই দেশের কোর কমান্ডার স্তরের বৈঠকে মুখোমুখি অবস্থান থেকে সেনা পেছনোর পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
এসডব্লিউ//এমএন/কেএইচ/১৩১৩
আপনার মতামত জানানঃ