পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিশ্বের প্রথম ড্রোন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই উত্তপ্ত অঞ্চলে ড্রোনের মাধ্যমে হামলা ও পাল্টা হামলা সংঘাতের নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা এটাকে ইতিহাসে প্রথম দুই দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ড্রোন-ভিত্তিক যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন।
আগে ড্রোন ব্যবহার হলেও (যেমন ইরাক, আফগানিস্তান বা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে), সেগুলো ছিল একপক্ষীয় বা হাইব্রিড যুদ্ধের অংশ। আগের যুদ্ধগুলোতে ড্রোন ছিল সহায়ক অস্ত্র, কিন্তু এখানে ভারত পাকিস্তান সংঘর্ষে এটি মূল হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ভারত-পাকিস্তান সরাসরি একে অপরের বিরুদ্ধে ড্রোন যুদ্ধে জড়িয়েছে, যা একটি নতুন ঘটনা।
গত বৃহস্পতিবার ভারত অভিযোগ করেছে যে পাকিস্তান ভারতীয় ভূখণ্ড ও ভারত-শাসিত কাশ্মীরে তিনটি সামরিক ঘাঁটিতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ইসলামাবাদ এই অভিযোগ তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান দাবি করেছে যে তারা গত কয়েক ঘণ্টায় ২৫টি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে। ভারত এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পাল্টাপাল্টি হামলা ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের শত্রুতাকে আরো বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এখন কেবল কামানের গোলাবর্ষণ নয়, অস্থির সীমান্তে উভয় পক্ষই ড্রোনের মতো মানববিহীন অস্ত্র ব্যবহার করছে। ওয়াশিংটন ও অন্যান্য বিশ্বশক্তি সংযত থাকার আহ্বান জানালেও ড্রোনের মাধ্যমে এই সংঘাত নতুন মাত্রা পেয়েছে।
মার্কিন নৌ-যুদ্ধ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাহারা ম্যাটিসেক বিবিসিকে বলেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ‘অদৃশ্য চোখ’ ও দূরনিয়ন্ত্রিত অস্ত্রই নির্ধারণ করবে যুদ্ধ কতদূর গড়াবে বা থামবে। এই আকাশে যেই পক্ষ ড্রোন যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ পাবে, মূলত তারাই রণভূমির নিয়ম তৈরি করবে।
লেজার-গাইডেড মিসাইল, বোমা, ড্রোন ও মানববিহীন আকাশযান (ইউএভি) আধুনিক যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এগুলো বিমান হামলার জন্য স্থানাঙ্ক নির্ধারণ করতে পারে, সরাসরি টার্গেট লক করতে পারে এবং তাৎক্ষণিকভাবে আক্রমণ চালাতে সক্ষম।
ড্রোনকে ডিকয় বা শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল করতেও ব্যবহার করা যায়। এটি বিতর্কিত আকাশসীমায় প্রবেশ করে শত্রুর রাডার সক্রিয় করতে পারে, যার পর অন্য অস্ত্র (যেমন লয়টারিং ড্রোন বা অ্যান্টি-রেডিয়েশন মিসাইল) সেগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। অধ্যাপক মাটিসেক বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে উভয় পক্ষই এই কৌশল ব্যবহার করছে। ড্রোনের এই দ্বৈত ভূমিকা— টার্গেট সনাক্তকরণ ও শত্রু রাডার সক্রিয় করা— এটিকে যুদ্ধের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ড্রোন বহর মূলত ইসরায়েলি তৈরি আইএআই সিচার ও হেরন রিকনেস্যান্স ড্রোন, হার্পি ও হ্যারোপ লয়টারিং মিউনিশনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। হ্যারোপ বিশেষভাবে উচ্চমূল্যের লক্ষ্যবস্তুতে সুনির্দিষ্ট হামলা চালাতে সক্ষম।
তবে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির মধ্য দিয়ে। যার আওতায় ভারত ৩১টি এমকিউ-৯বি প্রিডেটর ড্রোন কিনছে—যেগুলো ৪০ ঘণ্টা পর্যন্ত আকাশে থাকতে পারে এবং ৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম। ভারতের ড্রোন যুদ্ধ সক্ষমতায় এটি একটি যুগান্তকারী সংযোজন। ভারত ‘সোয়াম ড্রোন’ কৌশল নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে—অর্থাৎ অসংখ্য ছোট ড্রোন একসঙ্গে পাঠিয়ে শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করার পরিকল্পনা।
অন্যদিকে পাকিস্তানের ড্রোন বহরও ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময়। লাহোরভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ইজাজ হায়দার বিবিসিকে বলেন, পাকিস্তানের ড্রোন ভাণ্ডারে চীন, তুরস্ক ও স্থানীয় নির্মাণের এক হাজারের বেশি ড্রোন রয়েছে। এর মধ্যে চীনা সিএইচ-৪, তুরস্কের বায়রাখতার এবং পাকিস্তানের নিজস্ব বুরাক ও শাহপার ড্রোন উল্লেখযোগ্য।
ড্রোন যুদ্ধের এই নতুন অধ্যায় কেবল দুই দেশের সামরিক ব্যবস্থায় নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা রাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তনের বার্তা দিচ্ছে—যেখানে বোমা আর কামানের গর্জন নয়, নিঃশব্দে আকাশে ওড়া এক যান্ত্রিক পাখির সিদ্ধান্তেই নির্ধারিত হতে পারে ভবিষ্যতের যুদ্ধের ভাগ্য।
আপনার মতামত জানানঃ