সরকারি নির্দেশনায় চিকিৎসার নিয়মে বলা আছে, নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্ত ব্যক্তি আসার পর তাকে প্রশিক্ষিত লোক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কাউকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তাকে বিশেষ কক্ষে রাখতে হবে। ওই কক্ষের মেঝে ও দেয়ালে ফোমজাতীয় পদার্থ থাকবে, যাতে রোগী পড়ে গিয়ে এবং কোনোভাবে মাথায় আঘাত না পান। মাদক গ্রহণ করতে না পারায় রোগীর শরীরে কাঁপুনি, মলমূত্র ত্যাগ করাসহ বিভিন্ন উপসর্গ ও প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ওষুধ দিতে হবে। মাদকাসক্তি ছাড়াতে রোগীকে কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে রাখতে হয়। অথচ রংপুর নগরীর ‘প্রধান মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ এসবের থোরাই কেয়ার করেন। তারা রোগীদের চিকিৎসার নামে গোপনাঙ্গে ও চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেয়াসহ মলমূত্র খাওয়ানো এবং মারধর করে থাকেন। রংপুর নগরীর ‘প্রধান মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’র বিরুদ্ধে এমনি অভিযোগ উঠেছে।
নগরীর মেডিকেল পূর্বগেট এলাকায় অবস্থিত ওই মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে রোগীদের নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও গতকাল মঙ্গলবার রাতে ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে থাকেন রোগীদের স্বজন ও স্থানীয়রা।খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পালিয়ে যান নিরাময় কেন্দ্রের সকলেই।
পুলিশ ও রোগীদের স্বজনরা জানান, মঙ্গলবার রাতে সেখানে অবস্থানরত এক রোগীকে লোহার রড দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। এ খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে ওই রোগীর স্বজন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে যান। এ সময় অন্য রোগীরা চিকিৎসার নামে নিজেদের ওপর চলা শারীরিক নির্যাতনের ফলে সৃষ্টি হওয়া ক্ষত দেখিয়ে উদ্ধারের আকুতি জানান। নির্যাতনের সময় অনেককে বিবস্ত্র করে গোপনাঙ্গ ও চোখে মরিচের গুঁড়া দেয়াসহ মলমূত্র খাওয়ানোর অভিযোগও করেন রোগীরা।
চিকিৎসার নামে চলা নির্মম নির্যাতনের খবর পেয়ে অন্যান্য রোগীর স্বজনরাও রাতেই ছুটে আসেন। এ সময় নিরাময় কেন্দ্রের লোকজন তাদের ওপর চড়াও হন। এক পর্যায়ে রোগীর স্বজনরা স্থানীয় লোকদের সহায়তায় নিরাময় কেন্দ্র ঘেরাও করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে নিরাময় কেন্দ্রের লোকজন কৌশলে পালিয়ে যান।
পুলিশ সেখানে থাকা রোগীদের সাথে কথা বলে এবং তাদের শরীরে শারীরিক নির্যাতনের আলামত দেখে সেখান থেকে উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে।
এবিষয়ে রংপুর মহানগর পুলিশের অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার শহিদুল্লাহ কাওসার জানান, পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
খবর পেয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারাও সেখানে যান। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স থাকলেও তা নবায়ন করা হয়নি। ১০ জন রোগীর চিকিৎসার অনুমতি থাকলেও সেখানে মোট ২১ জনকে গাদাগাদি করে ছোট্ট দুটি ঘরে মেঝের ওপর রাখা হত। থাকার ও রান্নাঘরসহ পুরো কেন্দ্রটির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখতে পান কর্মকর্তারা। পরে মাদকাসক্ত নিরাময়ের নামে অপচিকিৎসাসহ বেশকিছু অনিয়ম থাকায় কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
আইন অনুযায়ী, নিরাময় কেন্দ্রে একজন মাদকাসক্ত রোগীর জন্য গড়ে কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা ও নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে। এতে একজন চিকিৎসক (মেডিকেল অফিসার), একজন মনোচিকিৎসক, একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স, একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও জীবন রক্ষাকারী উপকরণ এবং ওষুধপথ্য থাকতে হবে। এসবকে অমান্য করেই প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, একসময় যারা মাদকাসক্ত ছিলেন, তারাই এখন বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের মালিক। সেখানে চিকিৎসার নিয়মকানুন মানা হয় না। এসব কেন্দ্রে চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। তারা জানান, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে একেকজন একেক পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিচ্ছেন। কেউ আটকে রাখছেন, আবার কেউ মারধর করাটাকে চিকিৎসা বলছেন। এগুলো কোনো চিকিৎসা নয়। তারা মনে করেন, পিটিয়ে বা নির্যাতন করে নয়, তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার আধুনিক কৌশল আছে, তা জানতে হয়৷ সেই মানের চিকিৎসক কি প্রাইভেট ক্লিনিকে আছে? আর সরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা তেমন হয় না৷ তাদের টান থাকে কীভাবে প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠিয়ে পয়সা উপার্জন করবে৷ ওইসব ক্লিনিক-এর পিছনে অনেক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক আছেন৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৫১
আপনার মতামত জানানঃ