কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে এই সরকার? অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বলছে, শুধুমাত্র যেগুলোতে ঐকমত্য হবে সেগুলোই বাস্তবায়ন করা হবে এই সরকারের কাজ। বাকিগুলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের উপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। জামায়াতে ইসলামী তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছে, সংস্কার ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে নয় তারা। তবে বিএনপির অবস্থান পুরো উল্টো। তারা বলছে, ঐকমত্য ছাড়া কোনো সংস্কারই বাস্তবায়নের পক্ষে নয় তারা। বরং আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক রেখে আগে যতটুকু সম্ভব, সেটাই করার দাবি তাদের।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “সংস্কার কমিশন তো অনেক সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে সবগুলো রাজনৈতিক দল যে সংস্কারের ব্যাপারে একমত হবেন, সেগুলোই বাস্তবায়ন করা উচিত। প্রধান উপদেষ্টা বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে এমন আশ্বাসও দিয়েছেন। এছাড়া নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে তো জনগণের ম্যান্ডেট নিতে নিজেদের ঘোষণাপত্র করতেই হবে। তখন এগুলো এর মধ্যে চলে আসবে। ফলে সরকারের উচিত হবে, ডিসেম্বরে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক রেখে সংস্কার-কাজ করা।”
গত ৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্থার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের (প্রথম খণ্ড) পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। গত বছরের ৩ অক্টোবর সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশন গঠন করা হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল ৬ অক্টোবর। সবগুলো কমিশনকে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৯০ দিন সময় দেয়া হয়েছিল। পরে সেই সময় কয়েক দফা বাড়ানো হয়।
সবগুলো সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার পর আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সংস্কার জরুরি, তা শেষ করেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনে যেতে চায়। সংস্কার কমিশনগুলোর আশু করণীয়ের মধ্যে আছে, স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে, সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন আচরণবিধি প্রণয়ন, গণশুনানি এবং নাগরিকদের অভিযোগ শুনতে হবে, নাগরিক কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। জেলা উপজেলা পর্যায়ে স্থায়ী নাগরিক কমিটি গঠন, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা হ্রাস করা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ আর রাজস্ব বোর্ড একসঙ্গে এক প্রতিষ্ঠানে করতে হবে, নতুন দুটো বিভাগ- কুমিল্লা ও ফরিদপুর, জেলা প্রশাসককে জেলা কমিশনার হিসেবে অভিহিত করা, উপজেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন, সাব রেজিস্ট্রি অফিস সম্পূর্ণ ডিজিটাল করা, পাবলিক সার্ভিস কমিশন পুনর্গঠন।
এছাড়া আরো আশু করনীয় হিসেবে যেসব সুপারিশ আছে, তার মধ্যে আছে, জুডিশিয়াল সার্ভিস সদস্যদের জন্য আচরণবিধি নির্ধারণ, ফৌজদারি মামলা তদন্তে আলাদা ফৌজদারি সার্ভিস, বাণিজ্যিক আদালত গঠন, আদালতে সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ হবে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে, প্রতিটি আদালতে যেন ইনফর্মেশন ডেস্ক থাকে, অনলাইনে যেন পুলিশের সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যবস্থা থাকে, আদালত প্রাঙ্গনে রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিহারের নিয়ম প্রণয়ন, বিদ্যমান মামলা জট হ্রাস কল্পে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, আইনজীবীদের ফি নির্ধারণ, লিখিত চুক্তি ও রশিদ প্রদান বাধ্যতামূলক করা, যারা তদন্ত করবে, তাদের আলাদা ইউনিট থাকবে, পুলিশদের মানবাধিকার ট্রেনিং, আচরণবিধি প্রণয়ন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে হিউম্যান রাইটস কমিশন তদন্ত করবে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন গণমাধ্যম নীতিমালা সংশোধন, অনলাইন ভোটিংয়ের পরীক্ষা-নীরিক্ষা শুরু করা, দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় কৌশল বাস্তবায়নে ন্যায়পাল নিয়োগ, কালো টাকা কোনোদিনও সাদা করা যাবে না সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, রাজনৈতিক ও নির্বাচনি আইনে স্বচ্ছতায় শুদ্ধাচার চর্চা, বেসরকারি পর্যায়ের ঘুস লেনদেনকে শাস্তির আওতায় আনা ও দুদককে আরো শক্তিশালী করতে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।
আইন উপদেষ্টা বলেছেন, “যে প্রস্তাবগুলো নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেগুলো আমরাই বিবেচনা করবো। তবে এগুলো নিয়েও যদি রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা করতে চায়, সরকার আলোচনা করবে। সরকারের সহনশীলতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের উপর শ্রদ্ধাবোধের কারণে আওয়ামী লীগ এখনো কর্মসূচি দিতে পারছে।”
রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনগুলো জনগণ, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের কাছে দেবো, যাতে করে তারা একমত হতে পারেন; কী করলে তাদের ভালো হবে। আমি আশা করি, সবাই মিলে প্রস্তাবগুলো একমনে গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করবেন।”
নির্বাচন সংক্রান্ত জরুরি সংস্কারগুলো শেষ করেই জামায়াত জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় বলে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি সংস্কার ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে নয়। গত বৃহস্পতিবার ইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে এ কথা জানিয়েছেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার। তিনি বলেন, ‘‘নো ইলেকশন উইদাউট রিফর্মস (সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়)। রাষ্ট্রের সংস্কার নয়, শুধু নির্বাচনসংক্রান্ত যেসব সুপারিশ অতি জরুরি, অন্তত নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত, সেগুলোর সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জামায়াত ইসিকে নির্বাচনের কোনো দিন, মাস, ক্ষণ বেঁধে দেয়নি।”
জাতীয় পার্টির (এ) প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বর্তমান সরকারের উচিত হবে, যে সুপারিশগুলোর ব্যাপারে সবগুলো রাজনৈতিক দল একমত হবে, শুধুমাত্র সেগুলোই বাস্তবায়ন করা। কারণ, তারা যে অধ্যাদেশের মাধ্যমে এগুলো বাস্তবায়ন করবেন, সেগুলো পরবর্তীতে সংসদে বিল আকারে পাশ করার প্রয়োজন হবে। এখন কোনো রাজনৈতিক দল যদি কোনো সংস্কারের ব্যাপারে আপত্তি তোলে এবং সেই দল পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যায়, তাহলে সেটা কিন্তু তারা পাশ করবে না। ফলে, এতে স্থায়ী সংস্কারের ব্যাপারে ঝুঁকি থাকবে। তাই শুধুমাত্র ঐকমত্য হওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা উচিত।”
তবে ভিন্নমতও আছে। ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, “শুধু দৈনন্দিন কাজ করার জন্য জনগণ এই সরকারকে ক্ষমতায় বসায়নি। তাদের প্রধান কাজই সংস্কার করা। ফলে এই কাজটা তাদের করতে হবে। এখন সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে পরবর্তী যে সরকার আসবে, তারাও আগের সরকারের মতো হয়ে যাবে। আমাদের আইনি কিছু কাঠামো সেভাবেই তৈরি করা আছে। এগুলো এখনই সংস্কার করতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়ও আছে। এজন্য সরকারকে সবার সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। পরবর্তী সরকার যাতে কর্তৃত্ববাদী সরকার হয়ে না উঠতে পারে, সেই ব্যবস্থা এখনই করতে হবে। যে কারণে এই বিপ্লব, সেই আকাঙ্খাটা বুঝতে হবে।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমি মনে করি, এই সরকারের উচিত হবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য যে সংস্কারগুলো করা প্রয়োজন, সেগুলো করেই জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। তবে সেই সংস্কারগুলো অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে করতে হবে। কমিশনগুলো এত বড় বড় সুপারিশ করেছে, সেগুলো কে বাস্তবায়ন করবে? নির্বাচিত পার্লামেন্ট ছাড়া ওই কাজগুলো হবে না। তারা তো সংবিধানই বদলে ফেলতে বলেছে। এটা কি এই সরকার পারবে? ফলে নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই সংস্কারগুলো করা সম্ভব হবে আমরা মনে করি।”
ছয়টি সংস্কার কমিশন নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঐকমত্য কমিশন করেছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ, যিনি সংবিধান সংস্কার কমিশনেরও প্রধান। বাকি পাঁচ সংস্কার কমিশন প্রধানরা ঐকমত্য কমিশনের সদস্য হিসেবে রয়েছেন।
তারা হলেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক স্বরাষ্ট্র ও সংস্থাপন সচিব সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের প্রধান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ছয়টি কমিশনের কার্যক্রম ৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে। ঐদিন থেকেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যাত্রা শুরু। সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা রাজনৈতিক দল ও গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির কাছে পাঠানো হবে। এরপর রাজনৈতিক দল ও গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তির সঙ্গে আলোচনা এবং সমঝোতাক্রমে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও বলেছেন, ছয় কমিশনের পুরো প্রতিবেদন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির সঙ্গে কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কথার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে কতটুকু সংস্কার আসলে দ্রুত করতে হবে, কতটুকু পরে করা যাবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতেই জুলাই সনদ প্রণয়ন করবে সরকার। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ধরেন, ৫ হাজার সংস্কারের মধ্যে ২ হাজারের ব্যাপারে ঐকমত্যে এলেন, এই কনসেনশাসে যেটা রিচ হবে, সবাই একমত হবে, সেটা রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করবে। স্বাক্ষর করার পর যেটা দাঁড়াবে, সেটা হবে ‘জুলাই চার্টার’।”
তিনি বলেন, ‘‘জুলাই চার্টারের বাস্তবায়নের আলোকে নির্ভর করবে ইলেকশনটা এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে হবে, নাকি আগামী বছর জুলাইয়ের মধ্যে হবে।’
আপনার মতামত জানানঃ