জমিদার একটি ফারসি শব্দ এবং মোগল আমল থেকেই এর ব্যবহার হয়ে আসছে। ফারসি শব্দ ‘যামিন’, যার অর্থ জমি এবং ‘দাস্তান’ যার অর্থ ধারণ বা মালিকানা।
জমিদার একটি ফারসি শব্দ এবং মোগল আমল থেকেই এর ব্যবহার হয়ে আসছে। ফারসি শব্দ ‘যামিন’, যার অর্থ জমি এবং ‘দাস্তান’ যার অর্থ ধারণ বা মালিকানা। এই দুটি ফারসি শব্দের বাংলা অপভ্রংশের সঙ্গে ‘দার’ শব্দটি যুক্ত হয়ে ‘জমিদার’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, যার অর্থ ‘জমির মালিক বা ভূস্বামী’। জমিদার ও জমিদারবাড়ি সম্পর্কে সবারই কমবেশি আগ্রহ রয়েছে। তবে সঠিকভাবে জানা নেই যে কবে থেকে এই বঙ্গে জমিদারি প্রথা শুরু হয়েছিল। অনেকেরই ধারণা, ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে এই বঙ্গে জমিদারি প্রথা চালু হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে আজ থেকে ৬০০ বছরের বেশি সময় আগে থেকেই পূর্ববঙ্গে জমিদারি প্রথা চালু ছিল।
মূলত তুর্কি, আফগান বা সুলতানি শাসনামল থেকেই বঙ্গে জমিদারি ব্যবস্থা চালু ছিল বলে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন। ১৫১০ সালে বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে বনগাঁ কাগজ পুকুরিয়ার জমিদার ছিলেন রামচন্দ্র খাঁ। তিনি রাজস্ব প্রদান করতে অস্বীকার করলে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ জমিদার রামচন্দ্র খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে তাকে পরাজিত করেন। এছাড়া মোগল ও নবাবি শাসনামলে বঙ্গে সনদ প্রদানের মাধ্যমে জমিদারি প্রদান করা হতো। সে সময় প্রথা অনুযায়ী জমিদারি ছিল বংশগত। তখনকার জমিদাররা জমির স্থায়ী স্বত্বাধিকারী বা মালিক না হলেও রাষ্ট্রকে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় জমিদারি পরিচালনা করতেন। গুরুতর কোনো অপরাধ না করলে সেই সময় সাধারণত কোনো জমিদারকে জমিদারি থেকে উচ্ছেদ করা হতো না। ওই সময়ে রায়ত বা সাধারণ কৃষক ছিল জমির ভোগদখলকারী, জমিদাররা ছিলেন রাষ্ট্রের অধীন ভূমি-রাজস্ব আদায়কারী এবং রাষ্ট্র ছিল জমির প্রকৃত মালিক। ১৭৬৫ সালে ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয়। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে বঙ্গে প্রচলিত জমিদারি প্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়।
এ প্রথার মাধ্যমে রাজস্ব পরিশোধের বিনিময়ে বাংলা, বিহার, ওড়িশার জমিদারদের জমির ওপর স্থায়ী মালিকানা প্রদান করা হয়। ফলে জমিদারদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। ধীরে ধীরে তারা ধনিক শ্রেণীতে পরিণত হন। অন্যদিকে বংশপরম্পরায় বসবাস ও চাষাবাদ করে আসা প্রজারা জমির পুরনো স্বত্ব হারায়। ফলে তারা অন্য কারো কাছে তাদের জমি হস্তান্তরে ব্যর্থ হয়। এসব কারণে প্রজাদের জমিদারের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হতো। অনেক সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও এ দেশে এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রায় ২০০ বছর টিকে ছিল।
প্রাচীন যুগের জমির মালিকানা সম্পর্কিত তথ্যাদি অপ্রতুল। সেই সময় জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদের প্রাচুর্য থাকায় জমির মালিকানার বিষয়টি তখন তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তখন মানুষ তার নিজ বসতবাড়ির চারপাশের পতিত জমি ও জঙ্গল পরিষ্কার করে তাতে চাষাবাদ করত। তিনি জমির মালিক হতেন। জমি হস্তান্তরের বিষয়টি মালিকের স্বীকৃত অধিকার ছিল। কৃষিজমি কৃষকদের স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হতো। তারা বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারসূত্রে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে রীতিমাফিক কিংবা রাজা প্রণীত আইনের ভিত্তিতে প্রদেয় অর্থ পরিশোধ করে ওই জমি চাষাবাদ করত। যিনি রাজা বা শাসনকর্তা থাকতেন তিনিই রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন। তিনি রাজকর্মচারীদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করতেন।
প্রাচীন যুগে ভূমির প্রকৃত মালিক কে ছিলেন সে বিষয়ে মতভেদ থাকলেও বিভিন্ন সময়ে ভূমি ব্যবস্থা সম্বন্ধে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে অনুমান করা যায় যে রাজা বা রাষ্ট্র এ দেশের সব জমির মূল স্বত্বাধিকারী এবং মূল মালিক দুই-ই ছিলেন। গুপ্ত যুগের যে কয়টি লিপি পাওয়া গেছে তার প্রতিটিতেই দেখা গেছে যে জমিবিক্রেতা হচ্ছেন রাজা বা রাষ্ট্র এবং বিক্রীত জমি ধর্মাচারের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত হতো বলে রাজা দানপুণ্যের এক-ষষ্ঠ ভাগের অধিকারী হতেন। তবে রাজা ভূমির অধিকারী হলেও দান বিক্রয়ে যথেচ্ছাচার করতেন না। প্রস্তাবিত জমি দান ও বিক্রীত হলে গ্রামবাসীদের কৃষি ও অন্যান্য কর্মের কোনো অসুবিধা হবে কিনা এসব চিন্তা করা হতো।
বৌদ্ধ ও হিন্দু যুগে ভূমি-রাজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থা সম্বন্ধে সঠিক কিছু জানা যায় না। তবে বৌদ্ধ যুগে রাজারা জমির স্বত্বাধিকারী না হলেও প্রজাদের কাছ থেকে কর হিসেবে ফসলের অংশবিশেষ গ্রহণ করতেন। আর হিন্দু যুগে জমিতে প্রজাদের মুখ্য ও ব্যক্তিগত অধিকার থাকায় পরিবারের প্রধান তার ইচ্ছানুযায়ী জমি দান, বিক্রয় বা অন্য কোনোভাবে জমি হস্তান্তর করতে পারতেন। কৃষকেরা যারা তাদের জমি চাষের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না, রাজা তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারতেন। প্রাচীন যুগের মতো বৌদ্ধ ও হিন্দু যুগেও মোট উৎপাদনের এক-ষষ্ঠাংশ রাজার প্রাপ্য অংশ হিসেবে বহাল ছিল। বৌদ্ধ ও হিন্দু যুগে সাধারণত শস্যের মাধ্যমে রাজস্ব প্রদান করা হতো। রাজার তরফ থেকে রাজস্ব আদায়কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা রাজস্ব সংগ্রহ করতেন। পরবর্তী সময়ে বাংলায় সেন রাজাদের আমলে ধাতব মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব প্রদান ব্যবস্থার প্রচলন হয়।
সুলতানি আমল থেকে ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কিত কিছু তথ্য পাওয়া যায়। বাংলায় সুলতানি শাসকরা, শেরশাহ ও কররানী বংশের শাসনামল ছিল মুসলমান শাসকদের রাজত্বকাল। শুরুর দিকে লক্ষ্মণাবতীর মুসলিম শাসকরা হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগের প্রবর্তিত ভূমি ব্যবস্থাই অনুসরণ করতেন। পাল ও সেন আমলে যে রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়, মুসলিম শাসনামলে তার গুরুত্ব বেড়ে যায়। ফলে রাজা ও রায়ত বা কৃষকের মাঝে আরো বেশি করে নানা ধরনের স্বত্বাধিকারী বা ভূস্বামী তৈরি হয়। তারা রাজস্ব আদায়কারী হলেও কার্যত ভূস্বামীই ছিলেন। অনেক সময় তারা বংশানুক্রমিকভাবে ভূমির স্বত্ব ভোগ করতেন।
সুলতানি শাসনামলে পরগনা শব্দটি প্রথম প্রচলন হয়। একগুচ্ছ গ্রাম মিলে একটি পরগনা গঠিত হতো। সুলতানি আমলে ভূমি মধ্যস্বত্ব বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল জায়গির ব্যবস্থা। এর আওতায় জমি বা তালুক বরাদ্দ করা হতো। সুলতানরা আগের মতোই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রজাদের কাছ থেকে সরাসরি জমির রাজস্ব আদায় করেন আর এ কর সংগ্রহের কাজে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই ভূমি-রাজস্ব আদায়ে অবশ্য ‘মাজমাদার’ পদবিধারী মধ্যবর্তী একটি শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল।
‘মাজমাদারি’ ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কতটা ব্যাপক ও সংগঠিত ছিল তা খুব স্পষ্ট না হলেও সুলতানরা যে রাজস্ব আদায়ের কাজে সম্পর্কিত চাষীদের মাধ্যমে জমির খাজনা সংগ্রহ শুরু করেছিলেন তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। ভারতের প্রাচীন শাসকদের নিভি-ধর্ম মধ্যস্বত্ব প্রদানের মতো সুলতানরাও ধর্মীয় ও দাতব্য সংগঠন এবং ব্যক্তিবিশেষকে লাখেরাজ বা নিষ্কর জমির মঞ্জুরি দিতেন, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের মঞ্জুরির ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল।
সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ সাল) প্রথম রাজস্ব প্রশাসনের ভিত্তি স্থাপন করেছেন বলে ধারণা করা হয়। ওই সময় সমগ্র রাজস্ব এলাকাকে দেওয়ানিখানা নামক অনেকগুলো প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত করা হয়। এগুলোই সেই সময়ের রাজস্ব প্রশাসনের ভিত্তি। পরবর্তী সময়ে এগুলো পরগনা হিসেবে পরিচিত হয়। ১৫৩৮ সালে দিল্লির সম্রাট শের শাহ বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন সুলতান গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহর রাজধানী গৌড় জয় করে তার প্রশাসকদের হাতে তা ন্যস্ত করেন।
কিন্তু তিনি বাংলার সর্বত্র তার ক্ষমতা সংহত করতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে উচ্ছেদকৃত শাসকদের সমর্থকদের কমপক্ষে তিনটি বিদ্রোহের দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলার নদীবিধৌত এলাকা সবসময়ই কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য একটি সমস্যা ছিল। এ সমস্যা সমাধানকল্পে শেরশাহ বঙ্গ দেশকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করেন। এই ১৯টি সরকার আবার ৩২টি মহল বা পরগনায় বিভক্ত হয়।
আপনার মতামত জানানঃ