সূর্যের রঙ কী ? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই হয়তো বলবেন, সূর্য হলুদ। কেউ আবার কমলা কিংবা লালও বলতে পারেন। কিন্তু আদতে রংধনুর সব রঙই প্রায় সমান মাত্রায় নিঃসরিত হয় সূর্য থেকে, আর সকল রঙের এই সংমিশ্রনই আমাদের চোখে সাদা হয়ে ধরা দেয়। তবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল তাঁর নিজের রঙ ছড়ায় বলে পৃথিবী থেকে সূর্যকে ভিন্ন ভিন্ন রঙে দেখা যায়। মহাকাশে এ বালাই নেই, তাই সেখানে সূর্য সদাই সাদা। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে রহস্যজনকভাবে পৃথিবী থেকে সূর্যকে একবার নীল দেখা গেছে। কেন এমনটা হয়েছে, তার কারণ অবশেষে জানতে পারলেন বিজ্ঞানীরা।
১৮৩১ সালে বিশাল এক আগ্নেয়গিরি’র অগ্ন্যুৎপাতের কারণেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সূর্যকে নীল হতে দেখা গেছে। কীভাবে এমনটা হলো? আগ্নেয়গিরি’র অগ্ন্যুৎপাতের কারণে বিশাল পরিমাণ সালফার ডাইঅক্সাইড পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়, ফলে বিশ্বব্যাপী আবহাওয়া স্বাভাবিকের চেয়ে শীতল হয়ে পড়ে এবং সে বছর পৃথিবীর জলবায়ু বেশ অদ্ভুত আচরণ করে।
জাভারিৎস্কি নামের এই আগ্নেয়গিরিটির অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয় জনবসতিহীন সিমুশির দ্বীপে- যেটি বর্তমানে জাপান ও রাশিয়ার মধ্যকার এক বিতর্কিত অঞ্চল। সম্প্রতি আমেরিকার প্রোসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস (পিএনএএস)-এর জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে এই তথ্য জানা যায়।
১৮৩১ সালের এই অগ্ন্যুৎপাতটি সরাসরি পর্যবেক্ষণের কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। কেননা এটি সংঘটিত হয় দূরবর্তী এবং প্রায় জনমানবহীন এক দ্বীপ সিমুশিরে। তবে তাতেও দমে যাননি স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী। ১৮৩১ সালের এক খন্ড আইস কোর (সিলিন্ডার আকারের এক খন্ড বরফ) বিশ্লেষণ করে তাঁরা ঠিকই খুঁজে পেয়েছেন এই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সত্যতা এবং এর প্রভাব সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য।
উক্ত গবেষণার সহ-লেখক উইল হাচিসন এক বিবৃতি’তে বলেন, ‘ল্যাবে ঠিক যে মুহুর্তে আমরা দু’খন্ড ছাই- যার একটির উৎপত্তি আগ্নেয়গিরি থেকে এবং অন্যটির আইস কোর- এক সাথে বিশ্লেষক করি সেটা ছিল সত্যিই এক অসাধারণ মুহূর্ত।’
তিনি আরও বলেন যে, খুব উচ্চ টেম্পোরাল রেজোলিউশনে বরফের রসায়নটি বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে তাঁরা জানতে পারেন অগ্ন্যুৎপাতটি সংঘটিত হয় ১৮৩১ সালের বসন্ত-গ্রীষ্মকালে এবং এটি অত্যন্ত বিস্ফোরক ছিল। শুধু তাই নয়, তাঁরা এই রসায়ন থেকে ছাইয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরোও বের করতে সক্ষম হয়েছে।
তবে ১৮৩১ সালের বিশাল এই আগ্নেয়গিরি’র অগ্ন্যুৎপাত এবং সূর্যের উপর এর প্রভাব সম্পর্কিত রহস্যের উন্মোচন করতে সমর্থ হলেও হাচিসন মনে করেন, এমন বড় আকারের অগ্ন্যুৎপাত সম্পর্কে আগেভাগে অনুমান করার মতো যথেষ্ট প্রযুক্তিগত উন্নতি করা সম্ভব হয়নি এখনও।
হাচিসন বলেন, ‘যদি এমন একটি অগ্ন্যুৎপাত আজ সংঘটিত হয় তাহলে আমার মনে হয় না যে আমরা ১৮৩১ এর তুলনায় ভালো অবস্থানে থাকবো। এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, জলবায়ু-পরিবর্তনকারী বড় ধরণের অগ্ন্যুৎপাত কবে কোথায় সংঘটিত হতে পারে এ সম্পর্কে পূর্বানুমান করা বেশ কঠিন একটি কাজ।
উল্লেখ্য, ১৮৩১ সাল ছাড়াও বড় ধরণের আগ্নেয়গিরি’র অগ্ন্যুৎপাত দেখেছে পৃথিবীবাসী। এই যেমন ১৮১৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট তাম্বোরার অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনায় পুরো এক বছর গ্রীষ্মকাল দেখা যায়নি পৃথিবীব্যাপী। এই অগ্ন্যুৎপাতটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ২৪ কিউবিক মাইল সমপরিমাণ গ্যাস, ধূলা ও পাথর নিঃসরণ করে, যার ফলে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা পড়ে যায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। বিশেষ করে উত্তর গোলার্ধে সে বছর ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হ্রাস পায়।
বিজ্ঞানীরা সাবধান করে দিয়েছেন যে, চলতি শতাব্দী’তে এমন বড় আকারের আগ্নেয়গিরি’র অগ্ন্যুৎপাত সংঘটির হওয়ার সম্ভাবনা ছয় ভাগের মধ্যে এক ভাগ। আর এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কি পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ও জনদুর্ভোগ হতে পারে সেটা কিছুটা হলেও আঁচ করা যায় বর্তমানে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে চলমান দাবানল থেকে।
১৮৩১ সালের মতো বড় ধরণের আগ্নেয়গিরি’র অগ্ন্যুৎপাতের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি জীবননাশের ঝুঁকিতো রয়েছেই। এমন দুর্যোগের কারণে পৃথিবীর সার্বিক তাপমাত্রা সাময়িকভাবে হ্রাস পেলেও বায়ুমণ্ডলে ক্রমবর্ধমান গ্রিনহাউজ গ্যাসের কারণে পৃথিবীব্যাপী উষ্ণতা আবারও আগের জায়গায় পৌঁছতে খুব একটা সময় লাগবে না।
আপনার মতামত জানানঃ