করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে, যা কভিডের আগের হারের প্রায় দ্বিগুণ। দারিদ্র্যের পাশাপাশি সমাজে বৈষম্যও বেড়েছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দেশের বর্তমান দারিদ্র্যের হার আবার শহরের থেকে গ্রামীণ অঞ্চলে বেশি প্রকট। শহর অঞ্চলে এই হার ৩৫ শতাংশ হলেও গ্রাম অঞ্চলে এই হার ৪৫ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
‘দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব: সানেমের দেশব্যাপী জরিপের ফলাফল’ শিরোনামের শনিবার একটি ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওয়েবিনারে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। ওয়েবিনারে আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
২০১৮ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সঙ্গে যৌথভাবে ৬৪ জেলার ১০ হাজার ৫০০ খানার ওপর জরিপ হয়। এর মধ্যে গত বছরের ২ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৫৭৭টি খানার ওপর টেলিফোনে জরিপ করেছে সানেম। কভিডের আগের সঙ্গে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতির তুলনা করতে এ জরিপ করা হয়।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালে জিইডি ও সানেমের জরিপে এ হার ছিল ২১ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বিবিএসের খানা জরিপে ২০১৬ সালে গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র মানুষ ছিল ২৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপে ছিল ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। সানেমের সর্বশেষ জরিপে তা বেড়ে ৪৫ দশমিক ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
এদিকে শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০১৮ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে বেড়ে হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪০ শতাংশ।
চরম দারিদ্র্যের হারের (লোয়ার পোভার্টি রেট) ক্ষেত্রে ২০১৬ সালে বিবিএস’র খানা জরিপ অনুসারে এই হার ছিলো জাতীয়ভাবে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে ২০২০ সালে মহামারির প্রভাবে এই হার বেড়ে হয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার এখন ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ। শহরাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ১৯ শতাংশ।
২০২০ সালে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বরিশালে ছিলো ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ, ঢাকায় ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ, খুলনায় ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ, রংপুরে ৫৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সিলেটে ৩৫ শতাংশ।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, দেশে ২০২০ সালে ২০১৮ সালের তুলনায় মাথাপিছু গড় শিক্ষা ব্যয় কমেছে। অতি দরিদ্র পরিবারের জন্য এ হার কমেছে সবচেয়ে বেশি (৫৮ শতাংশ)। অন্যদিকে গড় মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে, মধ্যম দরিদ্র (৯৭ শতাংশ) এবং অ-দরিদ্র (১০৪ শতাংশ) পরিবারের জন্য এটি সবচেয়ে বেশি।
এ গবেষণায় অনলাইন (টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদি) শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণও পর্যালোচনা করা হয়। গ্রামাঞ্চলের ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং শহরাঞ্চলের ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষায় অংশ নিতে পেরেছে। অনলাইন শিক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৫ শতাংশ দরিদ্র পরিবারের এবং ২৬ শতাংশ অ-দরিদ্র পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। উত্তরদাতারা অনলাইন শিক্ষায় অংশ নিতে না পারার কারণ হিসেবে অনলাইন ক্লাসের অপ্রাপ্যতা (৪৯ দশমিক ১ শতাংশ), প্রয়োজনীয় ডিভাইসের অপ্রাপ্যতা (৬ দশমিক ১ শতাংশ), ডিভাইসের অপ্রতুলতা (৫ দশমিক ৩ শতাংশ), ইন্টারনেট সংযোগের অপর্যাপ্ততা (৫ দশমিক ৪ শতাংশ), ইন্টারনেট সংযোগের ব্যয় বহন করতে অক্ষমতার (৬ দশমিক ৫ শতাংশ) কথা উল্লেখ করেছেন।
মহামারির ফলে কাজ হারানো, পারিশ্রমিক না পাওয়া, কর্মক্ষেত্র বন্ধ হওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসংস্থান-সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কেবল ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবারের দাবি ছিল যে তাদের সদস্যরা আগের মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে পেরেছে। ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার দাবি করেছেন যে কাজ থাকা সত্ত্বেও তাদের আয় হ্রাস পেয়েছে, ৮ দশমিক ৬ শতাংশ দাবি করেছে যে তারা কাজ হারিয়েছে।
জরিপে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে, সব ধরনের কর্মসংস্থানে গড় আয় হ্রাস পেয়েছে, যা স্ব-নিযুক্তদের জন্য ৩২ শতাংশ, বেতনভিত্তিক কর্মীদের জন্য ২৩ শতাংশ, দিনমজুরের জন্য ২৯ শতাংশ এবং অন্যদের জন্য ৩৫ শতাংশ।
তবে সঙ্কটের মোকাবেলার জন্য তারা বিভিন্ন ধরণের কৌশল অবলম্বল করেছে। ৪৮ দশমিক ৭২ শতাংশ ঋণ নিয়েছে, ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ সঞ্চয়ের উপর নির্ভরশীল, ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ খাদ্য-ব্যয় কমিয়েছে, ২৭ শতাংশ তাদের খাদ্যতালিকায় অনিচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে এবং ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বন্ধু বা আত্মীয়ের কাছ থেকে অনুদান নিয়েছেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. এম এম আকাশ বলেন, কোভিডের কারণে যে ক্ষতি হলো এটি কি স্বল্পমেয়াদি, নাকি এত বছরের অগ্রগতির ওপরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ল, সেটি ব্যাখ্যার বিষয়। এটি নির্ভর করবে ক্ষতির ধরন কেমন, কোন খাত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সরকার যে জরুরি পদক্ষেপ নিলো তা কতটুকু পর্যাপ্ত তার ওপর। আয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে (আল্টা রিচ) যারা আছেন তাদের বিষয়েও গবেষণা হওয়া দরকার যা দেশব্যাপী জরিপে সাধারণত উঠে আসে না। খাদ্য-বহির্ভূত ব্যয় কমে গেছে, কোন খাতে কতটুকু সেই অনুপাত জানা প্রয়োজন। মোকাবেলার ধরন যেমন ধার নেয়া, সঞ্চয় ব্যয় করা ইত্যাদির সঠিক পরিমাণ জানা গেলে আরো ভালো হতো। দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে পুনোরুদ্ধারের জন্য শিক্ষা খাতকে যত দ্রুত সম্ভব চালু করতে হবে, স্বাস্থ্য খাতে ভর্তুকি দিতে হবে, কর্মসংস্থানের পরিবর্তনগুলো স্বীকার করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ে দারিদ্র্যের ওপর প্রভাব পড়ছে এবং কোভিড-১৯ এর পূর্বের দারিদ্র্য বিষয়ক অর্জনগুলো কোভিড-১৯ এর প্রভাবে উল্টে যাবে, সেই ধারণাটি আরো জোরালো হয়েছে এই সমীক্ষার মাধ্যমে। স্বাভাবিক সময়েও আয় বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য ও ভোগ বৈষম্য বজায় ছিল, অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল অসম। এই কঠিন সময়ে টিকে থাকার লড়াইতে দরিদ্রদের জন্য যথেষ্ট উপায় নেই, আর যারা সচ্ছল তাদের ওপর অত প্রভাব পড়ে না। কাজেই এই অসাম্য থেকে হয়তো আমরা খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি পাবো না।
তিনি বলেন, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে ধরনের উদ্যোগ বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি সেটি আমরা দেখছি না, যদিও করোনা মোকাবেলার পাশাপাশি এই উদ্যোগগুলো নেয়া সম্ভব। যে প্রবৃদ্ধির পথে আমরা এগোচ্ছিলাম তা ছিল কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি, কোভিডের প্রভাবে এতে আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যে কর্মসংস্থান হারিয়েছি সেটি পুনোরুদ্ধারে এবং নতুন করে আরো কর্মসংস্থান তৈরিতে আগামী বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে। কোন ধরনের কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগ করছি, বিনিয়োগের সময় সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ কর্মজগতে পরিবর্তন আসছে। প্রযুক্তির ব্যবহার আরো ত্বরান্বিত হবে ভবিষ্যতের জন্য আমরা প্রস্তুত কি না তা ভাবার সময় এসেছে, কারণ প্রযুক্তির আগ্রাসনের ফলে বহু কর্মসংস্থান বিলীন হয়ে যাবে এবং অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৮
আপনার মতামত জানানঃ