রাজধানীর মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার এবং খাবার পানির প্রধান উৎস ওয়াসা। ওয়াসার পক্ষ থেকে এ পানিকে সুপেয় বলা হলেও এবার সেই পানিতে পাওয়া গেছে ক্যান্সারসহ মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর মারাত্মক সব রাসায়নিক উপাদান। সম্প্রতি ঢাকায় ওয়াসার পানির উপর চালানো এক গবেষণায় একাধিক বিষাক্ত উপাদান এমনকি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী যৌগের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। ক্ষতিকারক এসব উপাদানের মধ্যে আছে- টেক্সটাইল, জাহাজ ভাঙারি, তেল পরিশোধন, প্রসাধন সামগ্রী, পরিষ্কারক এবং শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ। দূষিত এই পানি গ্রহণ মারাত্মক স্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি ‘পিএফএএস বাংলাদেশ সিচুয়েশন রিপোর্ট ২০২০’ নামের এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর দু’টি স্থান থেকে সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ করে পারফ্লোরোএক্টনোইক এসিড (পিএফওএ) এবং পারফ্লোরোএক্টেন সালফোনিক এসিডের (পিএফওএস) উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বিশ্বব্যাপী শিল্প উৎপাদনে বহুল ব্যবহৃত দুই রাসায়নিক যৌগ হল পারফ্লুরোঅকটানোয়িক এসিড (পিএফওএ) এবং পারফ্লুরোঅক্টেন সালফোনিক এসিড (পিএফওএস)। পিএফওএ ও পিএফওএস মূলত পলিফ্লুরো আলকালাইল সাবস্ট্যান্সের (পিএফওএস) গোত্রভুক্ত রাসায়নিক। পানিতে দ্রুত মিশে যাওয়া এবং সব ধরনের প্রাকৃতিক পরিস্থিতি সহনীয় হওয়ার ফলে সর্বত্রই এই রাসায়নিকের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় সারফেস বা পৃষ্ঠজল এবং কলের পানি- উভয় জায়গাতেই উপাদান দুটির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা নগরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে দ্রুততার সাথে ক্ষতিকর পদার্থগুলো অপসারণের পরামর্শ দিয়েছেন। তা না হলে, বিষাক্ত এই পানি মানবদেহে প্রাণঘাতী প্রভাব ফেলতে পারে।
২০১৯ সালে ঢাকার লালমাটিয়া, বনানী এবং সাভারের পানপাড়া বাজার থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশনের (এসডো) তত্ত্বাবধানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়।
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী লালমাটিয়া থেকে সংগৃহীত নমুনায় প্রতি ট্রিলিয়নে (পিপিটি) ৮ পিপিটি, পানপাড়া এলাকার পানিতে ৬.৮ পিপিটি এবং বনানী এলাকার পানিতে ৫.১৮ অংশ পিপিটি পিএফওএ’এর উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। অপরপক্ষে ২.৩ পিপিটি পিএফওএস লালমাটিয়াতে, ২.৬ পিপিটি পানপাড়ায় এবং ৫.১৮ পিপিটি বনানীর পানির নমুনায় শনাক্ত হয়েছে।
এসডোর রিপোর্টে ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার জলাভূমিতে পিএফএএস গোত্রের ক্ষতিকর আরো ১৩ প্রকারের রাসায়নিকের উপস্থিতির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
ইএসডিও ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় পৃষ্ঠজল ও ট্যাপের পানিতে পিএফএওএস গোষ্ঠীর সর্বাধিক ক্ষতিকর তেরোটি যৌগের উপস্থিতি নির্ণয়ে গবেষণাটি পরিচালনা করে।
এদিকে প্রতিবেদনটি পর্যালোচনার পর ওয়াসা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের পরিচালক ড. গোলাম মোস্তাফা।
তিনি বলেন, “আমাদের হাতে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন আসেনি। আমরা প্রতিবেদনটি সংগ্রহ করে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে প্রেরণ করব”।
২০১৭ সালে পার্সিস্টেন্ট অরগানিক পলিউট্যান্টসের (পপস) সম্পর্কিত স্টকহোম কনভেনশনের পর্যালোচনা পরিষদ পিএফওএ যৌগের সাথে উচ্চ কোলেস্টেরল, আলসারেটিভ কোলাইটিস, থাইরয়েড, টেস্টিকোলার ক্যান্সার, কিডনি ক্যান্সার এবং গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপসহ মানব দেহের জটিল সব রোগের সম্পৃক্ততা চিহ্নিত করে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, পরিবর্তিত প্রাকৃতিক অবস্থাও পিএফওসের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এই দুটি রাসায়নিক পদার্থের সাথে অনান্য পিএফএএস মিলিতভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন ড. আবু জাফর মাহমুদ দেশের একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘পিএফএএস অত্যন্ত বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ। মানব দেহের রক্ত থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত উপাদানগুলো প্রভাব রাখে। এদের প্রভাবে ক্যান্সার হতে পারে। আমরা মার্কারি এবং সীসার ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে জানি। তবে পিএফএএসের সংস্পর্শে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে, তা এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। এই উপাদানগুলো জন্মের আগেই শিশুকে আক্রান্ত করতে পারে।’
ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, “বাংলাদেশে কোন কোন পণ্যে এসব পদার্থ ব্যবহৃত হচ্ছে তা আমরা পরিষ্কার জানি না। উপাদানগুলোর উৎস সংক্রান্ত কোনো গবেষণাও নেই। সাধারণত তেল পরিশোধক, শক্তি উৎপাদনকারী, জাহাজ-ভাঙা, প্রসাধন প্রতিষ্ঠান, কাঠ, রঙ, কাগজ এবং পাল্প, পরিষ্কারক, মোম এবং মেঝে পলিশ, অগ্নিনির্বাপক ফোম, পিভিসি এ রাবার কারখানা এবং ফটোগ্রাফি শিল্পে কেমিক্যালগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।”
তিনি জানান, “আমরা ঢাকা ওয়াসার কলের পানিতে এই রাসায়নিক উপাদানগুলো পেয়েছি। ঢাকা ইপিজেডে পানির প্রবাহে উচ্চমাত্রায় উপাদানগুলো পাওয়া গেছে। এর অর্থ হল, ইপিজেড শিল্পাঞ্চল থেকে পরিবেশে এই ক্ষতিকর উপাদানগুলো নিঃসৃত হচ্ছে”।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকার পানিতে পিএফএসের উপস্থিতি এক জরুরি সতর্ক বার্তা বহন করছে। এই পদার্থগুলো সহজে পরিবর্তিত হয় না এবং স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তারা বলছেন, যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে মাটি, পানি ও বায়ুতে এই রাসায়নিক উয়াপাদানের উপস্থিতি আরও বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পণ্যের উৎপাদনে এসব ক্ষতিকর পদার্থের ব্যবহার অপসারণ করতে হবে। যেসব শিল্প-কারখানা এসব উপাদান ব্যবহার করছে তাদেরও সরে আসতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৪
আপনার মতামত জানানঃ