দেশ দেশের এক দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি বা বিশেষ অবদানের জন্য নয়, বরং প্রশাসনের দুর্নীতি এবং শিক্ষার মান সংকট নিয়েই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরজুড়ে আলোচনায় থাকছে। বিশ্বজুড়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় দেশের একটিও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকা যেমন শিরোনাম হচ্ছে, তেমনি একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দুর্নীতি ও অনিয়মও নিয়মিতভাবেই সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। অবস্থা এতটাই বেগতিক যে, এখন খোদ রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্যই উপাচার্যদের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছেন। আর অন্য অনেকের মতো মন্ত্রীরাও এখন কথা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষার মান নিয়ে। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মো. আবদুল হামিদ বলেছেন ‘উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদের সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। তারা নিজেরাই যদি অনিয়মকে প্রশ্রয় দেন বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কী হবে, তা ভেবে দেখবেন।’ রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যকে সাধুবাদ জানিয়ে এই প্রশ্ন উত্থাপন করা জরুরি যে উপাচার্যদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিচার করার দায়িত্ব কার? উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া ও তাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার আচার্যের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্যের (রাষ্ট্রপতি) সাচিবিক কাজটি করে থাকে। রাষ্ট্রপতি ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে এসব বিষয় অবহিত করার মূল দায়িত্বও তাদের।
শনিবার দেশ রূপান্তরে ‘স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে নিয়োগ দিতে মরিয়া ভিসি শহীদুর’ শিরোনামের প্রতিবেদনে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুকৃবি) জনবল নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা অভিযোগ তুলে ধরা হয়। ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রহমান খান। তার বিরুদ্ধে অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য মাথাপিছু ১২-১৫ লাখ টাকা নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। এদিকে উপাচার্যের স্ত্রীর ওই বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে, এক মেয়ের শিক্ষক পদে এবং ছেলের কর্মকর্তা পদে আবেদন করেন। এভাবে পোষ্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বোর্ডের প্রধান থাকায় ভিসি শহীদুর রহমান খানের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ও ভিসির স্ত্রীর আবেদনের বিষয়টি নৈতিকতা পরিপন্থী। পোষ্যরা আবেদন করায় নিয়োগ বোর্ডের প্রধান ও সব ধরনের নিয়োগ কার্যক্রম থেকে উপাচার্যের সরে যাওয়া উচিত।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাম্প্রতিক বাস্তবতার পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ উঠলেও সাধারণত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এসব নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে বড়জোর কোনো কোনো উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া বা পদত্যাগের সুযোগ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য হওয়া শিক্ষকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বও দেন না। এমন অবস্থায় ক্ষমতাবান এসব উপাচার্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীন ইউজিসিও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। সরকার বললে কেবল তদন্ত করে সুপারিশ করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সেই তদন্তও আলোর মুখ দেখে না। এমনকি তদন্ত করতে গিয়ে উপাচার্যের চাপে ইউজিসির তদন্ত দলকে ফিরে আসারও উদাহরণ রয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের শুরুতেই অন্তত আট জন উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করেছে ইউজিসি। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তের দাবি রয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে কিছুদিন পরপরই কোনো না কোনো বিশ^বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের দুর্বার আন্দোলন হচ্ছে। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন পদত্যাগে বাধ্য হয়ে রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস ছাড়েন। গত বছর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম ইমামুল হকের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা তুমুল আন্দোলন গড়ে তুললে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটির নামে মেয়াদ শেষ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাকেও এভাবে মেয়াদ শেষ করার সুযোগ দেওয়া হয়। ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ-অনিয়মে রেকর্ড গড়া উপাচার্য মু. আবদুল জলিল মিয়া দুদকের মামলায় জেল খাটা একমাত্র উপাচার্য।
এমন বাস্তবতায় ভেবে দেখা জরুরি, কী করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের অভিযোগ সত্ত্বেও তারা পদে বহাল থাকছেন? ভেবে দেখা জরুরি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি ও প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের আনুগত্যের রাজনৈতিক বিবেচনা বন্ধ না হলে এই সংকট কাটিয়ে ওঠার ভিন্ন কোনো উপায় আছে কি?
আপনার মতামত জানানঃ