জনসংখ্যাবিদ ও জনসংখ্যার ইতিহাসের বিশিষ্ট গবেষক জন আর. উইকস বলেছেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।’ যদি আমরা খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ভেবে দেখি, তবে এ মন্তব্য অতিরঞ্জিত মনে হয় না।
জনসংখ্যাবিদ ও জনসংখ্যার ইতিহাসের বিশিষ্ট গবেষক জন আর. উইকস বলেছেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।’ যদি আমরা খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ভেবে দেখি, তবে এ মন্তব্য অতিরঞ্জিত মনে হয় না। জনমিতি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে—মাথাপিছু আয়, রাজনীতি, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে।
জনসংখ্যা নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাকে মোটা দাগে ডেমোগ্রাফি বলা হয়। এ বিষয়ে জন আর. উইকসের একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যায়, ‘হয়তো শুনলে উদ্ভট বা হাস্যকর মনে হতে পারে, তবে (সমাজের) প্রায় সবকিছুই ডেমোগ্রাফির সঙ্গে সংযুক্ত। তবে প্রকৃত সত্য এটাই যে জনমিতি সবকিছু নির্ধারণ করে।’ জনসংখ্যার বিন্যাস এবং বিস্তৃতি দুনিয়ার রাজনীতি ও সহিংসতায় গভীর প্রভাব ফেলে। যদি আমরা মধ্যপ্রাচ্যকে দেখি, তাহলে এ ধারণা আরো পরিষ্কার হবে। শিয়া ও সুন্নি জনসংখ্যার বিন্যাস, ভৌগোলিক অবস্থান ধর্মীয় সহিংসতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বহুমুখী ফ্রন্ট তৈরি করেছে। এসব পরিপ্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে এখন আমরা ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার জনসংখ্যাশুমারি বা আদমশুমারিসংক্রান্ত ইতিহাসে আলো ফেলে দেখতে পারি।
বাংলার ১৮৭২ সালের আদমশুমারি পরিচালনা করেছিলেন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন এইচ. বেভারলি। পুরো প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়েছিল সরকারি কর্মচারীদের মাধ্যমে। বিশেষত পুলিশ, রেজিস্ট্রেশন অফিসের কর্মচারী এবং ম্যাজিস্ট্রেট-কালেক্টররা এ প্রকল্পে কাজ করেছিলেন। গ্রামাঞ্চলে পাটোয়ারি, রায়ত ও দোকানদাররা এনুমেরেটর (গণনাকারী) হিসেবে কাজ করেছিলেন; জমিদাররা সম্ভবত স্থানীয় ইনুমারেটরদের তদারক করে এ প্রকল্পে সহায়তা করেছিলেন। এ গণনা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সফলভাবে শেষ করলেও দুটি ব্যতিক্রম ছিল—কুচবিহার ডিভিশন ও কলকাতা শহর—এ দুই জায়গায় গণনা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এ আদমশুমারিতে মোট ব্যয় ছিল ২ লাখ ১৬ হাজার রুপি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় তিনটি আদমশুমারি হয়েছিল; প্রথমটি ১৮৭২ সালে, দ্বিতীয়টি ১৮৮১ ও তৃতীয়টি ১৮৯১ সালে।
একটি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য জনসংখ্যা গণনার গুরুত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১৮৭২ সালের গণনার পর এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে বাংলায় প্রকৃত জনসংখ্যা পূর্বে ধারণা করা পরিমাণের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। দক্ষভাবে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সরকার ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি একটি আদমশুমারির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি। ১৮৬১ সালে প্রথমবারের মতো পুরো ভারতবর্ষব্যাপী জন গণনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া সিপাহি বিদ্রোহের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার কারণে সেটি সফল হয়নি। পরে ১৮৬৫ সালে স্যার সেসিল বিডন সরকারকে আদমশুমারির প্রকল্পটি পুনরায় শুরু করার জন্য প্রস্তাব দেন। ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি ছিল ব্রিটিশ ভারতের জনসংখ্যা গণনার নির্ধারিত তারিখ। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বাংলায় অধিকাংশ কাজ ১৮৭২ সালে করা হয়।
১৮৭২ সালের আগে বাংলায় আদমশুমারির কয়েকটি চেষ্টা সফল হয়নি। ১৭৮৭ সালে স্যার উইলিয়াম জোন্স বলেছিলেন যে বাংলার জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪০ লাখ। পাঁচ বছর পর মি. কোলব্রুক অনুমান করেছিলেন, এ সংখ্যা তিন কোটি হতে পারে। ১৮০৭ সালে ড. ফ্রান্সিস বুকানন বাংলার জনসংখ্যা নিরূপণের কাজে নিযুক্ত হন, কিন্তু তিনি তার কাজ শেষ করতে পারেননি। ১৮৩৫ সালে মি. অ্যাডাম ৩ কোটি ৫০ লাখ অনুমান করেছিলেন, কিন্তু এ অনুমান বিভ্রান্তিকর হওয়ায় ১৮৪৪ সালে জনসংখ্যা ৩ কোটি ১০ লাখ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ১৮৫৮ সালে থর্নটনের গেজেটিয়ারে বাংলার আয়তন ২ লাখ ৩ হাজার ৯৪৬ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ৪০ লাখ ৮৭১ হাজার ৯১ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৮৭২ সালে বাংলায় প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক জনগণনা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মোট জনসংখ্যা ৬৬ লাখ ৮৫৬ হাজার ৮৫৯ এবং মোট এলাকা ২ লাখ ৪৮ হাজার ২৩১ বর্গমাইল হিসেবে নির্ণয় করা হয়। বাংলার জনসংখ্যা অন্যান্য ভারতীয় প্রদেশগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ছিল। কিন্তু এ গণনাতেও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, যা ১৮৮১ সালের গণনায় অনেকাংশে সংশোধন করা হয়েছিল।
১৮৭২ সালের আদমশুমারির প্রতিবেদনে অনেক বর্ণবাদী মন্তব্য পাওয়া যায়। প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পর্বে বাংলার অধিবাসীদের সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘এরা বেশির ভাগ শারীরিকভাবে দুর্বল…!’ আদমশুমারিতে বাংলার নদীনির্ভর জীবনধারার উজ্জ্বল চিত্র উঠে এসেছিল। কর্তৃপক্ষের মতে, ‘এতগুলো নৌকার মধ্যে থাকা মানুষের গণনা করা ছিল একটি বড় সমস্যা।’ তারা অনুমান করেছিলেন যে প্রায় ৬০ হাজার নৌকা বাংলার নদীপথে চলাচল করছে, যেগুলোয় প্রায় তিন লাখ মানুষ অবস্থান করছিল।
১৮১৭ সালে জেমস মিল তার বিখ্যাত তিন খণ্ডের বই ‘হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে তিনি ভারতীয় ইতিহাসকে হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগে ভাগ করেন। এটি ছিল ভারতীয় ইতিহাস এবং জনগণের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি নতুন ওরিয়েন্টালিস্ট স্কুলের সূচনা। মিলের এ যুগ বিভাজনের ধারণাটি অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণবাদী ছিল এবং এ ধারণার অনুসারীরা বহু বর্ণবাদী মন্তব্য করেছিলেন। এরপর ১৮৭১ ও ১৮৭২ সালের মধ্যে প্রথম সর্বভারতীয় আদমশুমারি সম্পন্ন করা হয়। এটি ছিল বাংলায় প্রথম বৈজ্ঞানিক উপায়ে জনসংখ্যা গণনা। উদ্যোগটিকে ঔপনিবেশিক যুগের পরিসংখ্যান ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই প্রথম গণনায় ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু ব্রিটেনে তখন পর্যন্ত তাদের নিজেদের জনসংখ্যা গণনায় ধর্মীয় পরিচয় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ব্রিটিশ আদমশুমারি শুরু হয়েছিল ১৮০১ সালে।
বাংলায় আদমশুমারির সময় প্রশাসন একটি বিষয় নিয়ে অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়ে—কে হিন্দু এবং কে হিন্দু নয়—এ পরিচয় নির্ধারণ করাটা কঠিন হয়ে যায়। বিশেষত হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় আলাদা করা নিয়ে কর্তৃপক্ষ একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল। বাংলার লে. গভর্নর একটি বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যা থেকে ব্রিটিশদের বিভাজনমূলক শাসননীতির লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল। নির্দেশনাটি ছিল এ রকম—প্রতিটি জেলার জনশুমারির সংক্ষিপ্ত সারাংশ মুদ্রণ করা হবে এবং ভবিষ্যতের ব্যবহারের জন্য একটি বই আকারে সংরক্ষিত থাকবে। বইতে প্রতিটি শহর ও গ্রামের জনসংখ্যা মূলত দুটি বিভাগে বিভক্ত করা হবে। এক. ধর্মীয় বিভাগে বিভক্ত হবে: মুসলমান, হিন্দু বা ‘অন্যান্য’ ধর্ম; এবং দুই. কৃষক এবং অ-কৃষক শ্রেণীতে। ধর্ম আর পেশাই ছিল ব্রিটিশ জনগণনার দুই প্রধান বিভাগ। আদমশুমারির নথিতে জনগণকে পাঁচটি ধর্মীয় পরিচয়ে বিভক্ত করা হয়েছিল—হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য। ১৮৯১ সালে ভারতের আদমশুমারি প্রতিবেদনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য পাওয়া যায়—
আদমশুমারিতে বিভিন্ন তথ্যের যে লম্বা তালিকা আছে তাতে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়টি হচ্ছে ধর্মীয় জনসংখ্যার হিসাব। ভারতে আদমশুমারির মাধ্যমেই এ তথ্য উন্মোচন হয়েছে। এ বিবৃতি স্পষ্ট করে দেয়, আদমশুমারির মাধ্যমে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আকার সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল তা শাসক ও প্রজারা নিজ নিজ স্বার্থে কাজে লাগানোর আয়োজন শুরু করে দিয়েছিলেন।
১৮৭২ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনে একটি অধ্যায় ছিল ‘জনগণের ধর্মীয় পরিচয়’ শিরোনামে। খেয়াল করার বিষয়, ব্রিটেন তখনো তার নিজের দেশের আদমশুমারিতে এমন কোনো অপশন রাখেনি। ব্রিটিশরা তখন তাদের উপনিবেশে নতুন রাজনৈতিক শাসন কৌশল উদ্ভাবনে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে ধর্ম যে একটি ভালো অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে সেটা তারা বুঝে গিয়েছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কেঁপে গিয়েছিল। বিদ্রোহীরা অনেকখানেই ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। তাই তাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরির ভাবনা ব্রিটিশদের মাথায় জোরেশোরে কাজ করছিল। ১৮৭২ সালের আদমশুমারির প্রতিবেদনকে এ পরিপ্রেক্ষিত থেকে পাঠ করলে ব্রিটিশ নীতিকে বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এ আদমশুমারিতে বাংলায় মুসলিমদের বিপুল অবস্থানের তথ্যটি প্রথমবার কাগজে-কলমের হিসাবে প্রকাশিত হয়। এ উন্মোচন পরবর্তী সময়ে বাংলার রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। হিন্দু ও মুসলিম—উভয় সম্প্রদায়ই নিজেদের পরিচয়কে বিভিন্ন নতুন কাঠামোতে অনুভব করতে শুরু করেন।
১৮৭২ সালের বাংলার আদমশুমারি প্রতিবেদন এ প্রদেশে মুসলিম জনসংখ্যার উপস্থিতি সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা বিপুল, যা ২ কোটি ৫০ লাখের বেশি।’ নিতীশ সেনগুপ্ত তার বই Bengal Divided: The Unmaking of a Nation-এ উল্লেখ করেছেন, ১৮৮১ সালের গণনা প্রথমবারের মতো দেখিয়েছিল যে বাংলা প্রেসিডেন্সির ২৮টি বাংলাভাষী জেলার বেশির ভাগে মুসলিম সংখ্যার দিক থেকে হিন্দুদের থেকে অনেক বেশি। এছাড়া রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই মুসলিম। বাংলায় তখন মুসলিমদের সংখ্যা ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা হিন্দুদের সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি ছিল।
ধর্মীয় জনসংখ্যার এ উন্মোচন ব্রিটিশ শাসক, হিন্দু ও মুসলিম নেতাদের মাঝে নতুন মনোভাবের সূচনা করে। ব্রিটিশরা অনুভব করে বাংলায় মুসলিমরা যথেষ্ট শক্তিশালী। অন্যদিকে প্রান্তিক, কৃষিজীবী বাঙালি মুসলিমদের কাছে নিজেদের গুরুত্ব প্রকাশিত হয়। ১৮৯১ সালের গণনা রিপোর্টে, হিন্দু-মুসলিম ইস্যু সম্পর্কে একটি স্পষ্ট বক্তব্য ছিল এমন—
‘এ বিবৃতি (জনসংখ্যা পরিসংখ্যান) দেখায় যে হিন্দুদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে, এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষের সংখ্যা বেড়েছে (শিখ ব্যাতীত)।’ এরপর মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এ পরিসংখ্যান ও মন্তব্য স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচায়ক ছিল। রিপোর্টের মন্তব্য পড়ে মনে হতে পারে, বাংলায় কেবল মুসলমানদের সংখ্যাই বাড়ছে। এতে মুসলিম সংখ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত বললেও অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠী যেমন জৈন, ব্ৰাহ্ম ও বৌদ্ধদের বৃদ্ধি নিয়ে তেমন একটা মন্তব্য নেই।
রিপোর্টে আরো বলা হয়, ‘এটি স্পষ্ট যে বাংলার তিনটি প্রধান অঞ্চলের মধ্যে এবং প্রায় প্রতিটি জেলায় হিন্দুরা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং গত ২০ বছরে মুসলিমদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে…১৮৮১ সালের পর মুসলমানরা দিনাজপুর, বগুড়া, বাঁকুড়া ও হুগলি জেলা ছাড়া বাংলার আর সব এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। …
পরিসংখ্যানগতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে ১৮৭২ থেকে প্রতি ১০ হাজারে মুসলিমের সংখ্যা উত্তর বাংলায় ১০০ জন, পূর্ব বাংলায় ২৬২ জন ও পশ্চিম বাংলায় ১১০ জন বেড়েছে—মোটামুটি বাংলার প্রতিটি অংশে গড়ে ১৫৭ জন মুসলিম বৃদ্ধি পেয়েছে।’ এরপর শুমারি কর্তৃপক্ষ তথা ব্রিটিশরা এক চরম উসকানিমূলক বার্তা হাজির করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য। সেখানে বলা হয়, ‘হিন্দুদের ক্ষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে…মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছে এবং তারা এখন বিরাট জনগোষ্ঠী। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বাংলায় মুসলমানদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে সামনের সাড়ে ছয়শ বছরে।’
নিঃসন্দেহে এ পরিসংখ্যান ও মন্তব্য মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মানসিকতায় প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষত সংখ্যাগত অবস্থানের তথ্য বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর নেতারা বিবেচনায় নিতে শুরু করেন। নিজের সম্প্রদায়ের ভাগ্য পরিবর্তনে তাদের যে রাজনীতি সেখানে নিজেদের সংখ্যাগত অবস্থা শক্তি জোগায়। প্রদীপ কুমার লাহিড়ী তার বই Bengali Muslim Thought 1818-1947-এ বলেছেন, ‘বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধি মুসলিমদের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় প্রভাব ফেলেছিল। ব্রিটিশদের আগমনের আগে বাংলায় হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলার জনসংখ্যা পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়… মুসলিমদের জনসংখ্যাগত পরিবর্তন তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় একটি শক্তিশালী প্রভাব নিয়ে আসে। মুসলিম অভিজাত শ্রেণী এ সময়ের মধ্যে তাদের অধিকার ও সুবিধাদি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। ব্রিটিশ সরকারও মুসলিমদের তাদের সংখ্যাগত শক্তির গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, যাতে তারা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলার মুসলিম নেতারা অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা করার সময় বারবার তাদের সংখ্যাগত শক্তি তুলে ধরতে শুরু করেছিলেন।’
ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে জনসংখ্যা গণনা নিঃসন্দেহে আধুনিক রাষ্ট্রশাসনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় জাতিগত চেতনার উত্থানে ভূমিকা রেখেছিল এ জনগণনা বা আদমশুমারি।
আপনার মতামত জানানঃ