মোগল সাম্রাজ্যে ক্ষমতাকাঠামোর কেন্দ্রে ছিলেন শাসক। এ সময় সাম্রাজ্য কেবল ভৌগোলিকভাবেই বিস্তৃত হয়নি, শাসনের সুবিধার কথা বিবেচনা করে মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে প্রশাসন ও অর্থনীতিতে।
মোগল সাম্রাজ্যে ক্ষমতাকাঠামোর কেন্দ্রে ছিলেন শাসক। এ সময় সাম্রাজ্য কেবল ভৌগোলিকভাবেই বিস্তৃত হয়নি, শাসনের সুবিধার কথা বিবেচনা করে মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে প্রশাসন ও অর্থনীতিতে। পরবর্তী সামাজিক গতিশীলতায় এ পরিবর্তন ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। সে সময়ে ইউরোপ থেকে আসা বণিক ও পর্যটকদের লেখায় ফুটে উঠেছে এখানকার সমাজ ও জনজীবনের চালচিত্র। বিম্বিত হয়েছে দরবার ও দরবারের বাইরের ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকদের লেখায়ও।
যেহেতু মোগল আমলে জনজীবনের গতিশক্তি ছিল কৃষি; ফলে ভূমিবণ্টনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন শ্রেণী। বিপুল খাসজমি থাকার পরও কৃষকদের মধ্যকার বিভেদ ছিল চোখে পড়ার মতো। সাধারণত তিন ধরনের ভূমি মালিকানা দেখা যেত মোগল আমলে। প্রথমত, যারা সর্বস্বীকৃতভাবেই ভূমির মালিক, তাদের বলা হতো ‘খোদ কাশত’। দ্বিতীয় শ্রেণী ‘উপরি’ হলো ভিন্ন গ্রাম থেকে আসা চাষী; তারা ঠিক ভূমির মালিক না। তৃতীয় কাতারে ছিল ‘মুজারি’, তারা খোদ কাশতের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করত। ভূমি মালিকানার এ ব্যবধান প্রভাব ফেলেছিল তাদের জীবনাচারে। এর বাইরে ভূমি রাজস্বও সবসময় ও সব জায়গায় সমান ছিল না। রাজস্থানে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের জন্য ভূমি রাজস্ব ছিল এক-তৃতীয়াংশ কিংবা এক-চতুর্থাংশ। অথচ একজন সাধারণ কৃষকের জন্য ভূমি রাজস্ব ছিল অর্ধাংশ। এ ব্যবধান ভারতের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলের কৃষকদের জীবনমানে যেমন পার্থক্য তৈরি করেছে, একই সঙ্গে তৈরি করেছে একই স্থানে কয়েক কিসিমের কৃষক থাকার বোঝাপড়া।
মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ভারতবর্ষের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তার অমরগ্রন্থ বাবুরনামায়। তার দাবি, সে সময় সাধারণ মানুষ খালি পায়ে চলাফেরা করত। পুরুষরা সাধারণত একটা ছোট নেংটি পরত। মেয়েরা পরত শাড়ি। আকবরের দরবারে থাকা বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল দাবি করেছেন, বাংলার সাধারণ মানুষের শরীরের বড় অংশই থাকে অনাবৃত। কেবল একটা নেংটি পরে থাকে। সাধারণত মানুষের বড় একটা অংশই যে অনাবৃত থাকত, এ কথাই দাবি করেছেন সমকালীন পর্যটকরা। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ বণিক ও পর্যটক রালফ ফিচ অনেক বেশি স্পষ্ট। তার দাবি, সাধারণ মানুষের বড় একটা অংশই প্রায় নগ্ন থাকে। তবে শীতকালে সুতির গাউন পরিধান করে। ফলে পোশাকের অভ্যাসে যে ঋতুর প্রভাব ছিল তা ধারণা করা যায় সহজেই। নারীর শাড়ি হতো সাধারণত সুতির। ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারীদের বুক আবৃত করার চর্চা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছিল না। মালাবারের দিকে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে অনাবৃত থাকত। বাংলা ও আসামের দিকে ব্লাউজেরও ব্যবহার এসেছে অনেক পরে। হিন্দি কবি সুরদাসের লেখায় ধারণা পাওয়া যায়, বুক ঢাকার জন্য চোলি ও আঙিয়া ব্যবহার করা হতো, সাধারণত জুতা পরত না। মোরল্যান্ডের দাবি, বাংলা বাদে আর কোথাও জুতা ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। কারণ চামড়ার দাম ছিল অনেক বেশি। অবশ্য মধ্যযুগের সাহিত্যিক ও দার্শনিক তুলসিদাস ও সুরদাস পানাহি ও উপানাহা নামে দুই ধরনের জুতার কথা উল্লেখ করেছেন। নারীরা অলংকার পরতেন। অলংকার হতো স্বর্ণ, রৌপ্য ও অন্যান্য ধাতুর। সাধারণত নাক, কান এবং হাত ও পায়ের আঙুলে পরা হতো অলংকার।
বাংলায় অধিকাংশ কুঁড়ে তৈরি হতো বাঁশ দিয়ে। মাটির ঘরও ছিল খুবই সাধারণ। আসামে ধনী ও গরিব নির্বিশেষে ঘর তৈরি করত বাঁশ, কাঠ ও খড় দিয়ে। কাশ্মীরে বাড়ি তৈরি হতো কাঠ দিয়ে। উত্তর ও মধ্য ভারতে মাটির ঘর ছিল বেশি। কৃষকের ঘরে রান্নার জন্য ব্যবহার করা হতো মাটির বাসনকোসন। থাকত বাঁশের তৈরি মাচা ও মাদুর। খাবারের বৈচিত্র্য। আগ্রা ও দিল্লির দিকে গম জনপ্রিয় হলেও বাংলা, ওড়িশা ও উপকূলীয় অঞ্চলে জনপ্রিয় ছিল মাছ। বাঙালি জাতির প্রসঙ্গ এলেই আসে মাছ ও ভাতের প্রসঙ্গও। তবে যারা নদী থেকে দূরে বসবাস করত তারা মাছ কম খেত। গরু ও শূকরের মাংস খাওয়া নিয়ে এক ধরনের অনীহা ছিল ভারতে। বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলে খাবারের সঙ্গে ঘি ছিল অতি পরিচিত নাম। দুধ ও দুধজাত পণ্য সহজলভ্য হওয়ার কারণে নানা পদের মিষ্টান্ন খেত মানুষ। যদিও সবার জন্য সম্ভব হতো না বলেই মনে করেন ঐতিহাসিকরা। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম তার কবিতায় জানান, গরিবরা কেবল উৎসবের সময়ই সুস্বাদু খাবার খাওয়ার সুযোগ পায়। তবে তাভেরনিয়ার কিছুটা ভিন্ন মত দিয়েছেন। তার দাবি, সবচেয়ে ছোট গ্রামটিও চিনি, দুধ ও অন্যান্য মিষ্টান্ন প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করে। বিশেষ করে গুড়ের ভোক্তা গ্রামে বিপুল। লবণ ব্যবসায় বেশির ভাগ সময়েই সরকারি হস্তক্ষেপ থাকত। সে সময় মানুষের খাবারের তালিকায় ফলের মধ্যে প্রধান ছিল আম, তরমুজ, নারকেল।
প্রথম মোগল সম্রাট বাবুর দাবি করেছেন, ভারতে সব পেশার অজস্র মানুষ বিদ্যমান। নির্মাণশিল্পী ও শ্রমিকের বাইরে ছিল সামরিক কর্মকর্তাও। অভিজাত শ্রেণীরা বিপুলসংখ্যক ভৃত্য নিয়োগ দিতেন বাড়ির কাজ সামাল দেয়ার জন্য। একজন অভিজাত কখনই তার চাকর, দাস ও ভৃত্য ছাড়া বাইরে বের হতেন না। ১৯২০ সালে দাঁড়িয়ে মোরল্যান্ড চেষ্টা করেছিলেন সম্রাট আকবরের সময় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কেমন ছিল সেটা হিসাব করে বের করার। তারপর অনেক ঐতিহাসিকই চেষ্টা করেছেন তখনকার প্রেক্ষাপটে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিরূপণ করতে। গবেষক অশোক দেশাইয়ের দাবি, ১৫৯৫ ও ১৯৬১ সালের ক্রয়ক্ষমতা অনেকটা কাছাকাছি। তবে আকবরের সময়ের কম মজুরি পাওয়া শ্রমিকটাও পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারতেন; কারণ তখন মাংস, ঘি, চিনি, গুড় ও দুধ সস্তা ছিল। বিপরীতে লবণ, কাপড় ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের দাম আধুনিক সময়ে তুলনামূলকভাবে কম।
মোগল আমলে একটা কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম, কর ও গৃহের সংখ্যা পর্যন্ত তারা লিখে রাখতেন। এ বিপুল কাজের জন্য দরকার ছিল প্রচুর কর্মী। মনসবদারি ও জায়গির প্রথার কারণেও বিপুল পরিমাণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি হয়। তাদের দিয়েই মূলত গড়ে উঠেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণী। গোমস্তা, দালাল, পাইকারি বিক্রেতা, ব্যবসায়ী মিলে তৈরি হয়েছিল স্বতন্ত্র শ্রেণী, যাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকত। পেশাজীবী শ্রেণীর মধ্যে ছিল পণ্ডিত, মোল্লা, আইনজীবী ও হাকিম। অন্যদিকে সমাজে ব্রাহ্মণ ও মোল্লাদের প্রভাব ছিল মূলত ধর্মীয় বিষয়ে। এভাবে গড়ে ওঠা সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসেবে গড়ে উঠেছিল আশরাফ ও ভদ্রলোক। বাংলার ক্ষেত্রে দেওয়ান, বখশি ও কানুনগো গড়ে উঠেছিল স্থানীয় রাজাদের ছায়ায়। তাদের অনেকেই জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পরবর্তী সময়ে। মনসবদার, সিকদার, জায়গিরদারদের মাধ্যমেও একটা মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হয়; যারা বাংলা ও ভারতের অর্থনৈতিক গতিশীলতায় ভূমিকা রেখেছে। মোটা দাগে তাদের হাতেই পুনর্গঠিত হয়েছে পরবর্তী দিনের সাংস্কৃতিক ভাগ্য।
মোগল আমলে অভিজাতরা খাওয়ার পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করত। আবুল ফজলের দাবি, অভিজাতরা শত শত পদ তৈরি করাতেন খাওয়ার টেবিলে। ফল আমদানি করা হতো মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তান থেকে। বরফ তখন বিলাসপণ্য হিসেবে ব্যবহার হতো। খাবারে থাকত হরেক কিসিমের মসলা। অভিজাতরা শরাব পান করতেন অসংকোচে, যা আমদানি করা হতো পশ্চিম এশিয়া থেকে। হেরেমের ভেতরে থাকা নারীরাও বাদ যেতেন না। অভিজাতরা সাধারণত দরবারি পোশাকই পরিধান করতেন। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাপড় পরার ধরন প্রায় একই। অধিকাংশ সময়েই তা হতো সিল্ক কিংবা সুতির কাপড়। শীতের দিনে জামার ওপর দিয়ে থাকত ভারী কোট ও শাল। নারী ও পুরুষ উভয়েই অলংকার ব্যবহার করতেন। জাহাঙ্গীরের আমলে পুরুষদের কান ছিদ্র করে তাতে রিং পরার দলিল পাওয়া যায়। জীবনযাপনের এহেন বিলাসিতা ও আড়ম্বরতার কারণেই অভিজাতরা তাদের সচ্ছলতা হারাতে থাকে। তার পরও অনেক অভিজাত সম্পদ রেখে যেত। সেই সব সম্পদ মৃত্যুর পর তার কোনো ধারদেনা থাকলে মিটিয়ে দেয় হতো। তারপর অবশিষ্ট সম্পদ বণ্টন করে দেয়া হতো উত্তরাধিকারের মধ্যে। এ দায়িত্ব পালন করতেন খোদ শাসক।
মোগল দরবারের পোশাক-পরিচ্ছদ স্থানীয় অভিজাত শ্রেণীর জীবনাচারকেও প্রভাবিত করেছিল ব্যাপকভাবে। বাংলা থেকে জম্মু পর্যন্ত এর প্রভাব ছড়িয়ে ছিল। বিশেষ করে উপকূলীয় শহরগুলোয় বিপুলসংখ্যক বণিক বসবাস করত। জীবনযাপনের দিক থেকেও তারা ছিল যথেষ্ট বিলাসী। বাংলা ও গুজরাটের বণিকরা গড়ে তুলেছিল সম্পদের পাহাড়। এমন বণিকও ছিল যাদের ব্যবসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমান। তবে সময়ের ব্যবধানে তা ফিকে হয়ে গেছে। বেনিয়ারা বড় ঘর ব্যবহার করতেন। সুরাটে মুসলিম বণিকরা আলিশান গৃহে বসবাস করতেন। বাংলায় দুই ধরনের বাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন মঙ্গলকাব্যের কবি রূপরাম চক্রবর্তী। প্রথমটি চারচালা ও দ্বিতীয়টি বাংলা। এছাড়া জলাশয়ের মাঝখানে তৈরি করা হতো জলটুঙ্গি। অভিজাত ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর বাড়িঘর সাধারণত থাকত উৎসবপ্রধান। বিশেষ করে বিয়েতে ব্যাপক টাকা পয়সা খরচ করতেন তারা। মোগল আমলে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে সম্ভবত শাহজাদা দারা শুকোর বিয়েতে। তার বিয়ের খরচ ছিল ৩২ লাখ রুপি। এভাবে মোগল ভারত হয়ে উঠেছিল অভিজাতদের স্বর্ণভূমি। এমনকি আওরঙ্গজেব ক্ষমতায় আসার পরও তাদের জীবনাচারে পরিবর্তন আসেনি। অভিজাতরা শিল্পকলায় পৃষ্ঠপোষকতা দিত। বিশেষ করে গানের পেছনে। স্থানীয় রাজারাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল না। চিত্রকর্মকেও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে। মোগল আমলে সমাজের ওপরের স্তরে সাংস্কৃতিক সমন্বয় প্রক্রিয়া জারি ছিল।
ইতিহাস অভিজাতের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবতার সবচেয়ে বড় শিকার নিম্নবিত্ত। মোগল ভারতেও এর ব্যতিক্রম ছিল না সে অর্থে। দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাধারণত সমাজের নিচের স্তরের মানুষকে আঘাত করে। মোগল ভারতে সেই অংশটা ছিল মূলত ভূমিহীন কৃষক আর শ্রমিকরা। মোগল আমলে দাক্ষিণাত্যে ১৬৩০-৩১ সালে দুর্ভিক্ষ হয় বৃষ্টিহীনতার কারণে। কেবল আহমেদনগরেই তখন লাখ লাখ লোক মারা যায়। এছাড়া ১৬৫৫, ১৬৮২ ও ১৬৮৪ সালে ছোটখাটো দুর্ভিক্ষ হয়েছে। ১৭০২-০৪ সালে হয় আরো বড় এক দুর্ভিক্ষ। তবে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হওয়ার কারণে সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলোর দুর্ভিক্ষ দীর্ঘস্থায়ী হতো না। দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যারা মারা যায়নি, তারা নতুন করে যোগ দিয়েছে কৃষিতে। প্রাণপণে উৎপাদন করেছে ফসল। নতুন করে সবুজ হয়েছে মাটি। আবার কোলাহল ফিরেছে জনপদে। পরবর্তী দুর্ভিক্ষের পূর্ব পর্যন্ত।
আপনার মতামত জানানঃ