দেশের বিদ্যুৎ খাতের মাফিয়া হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আজিজ খান প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রায় ২শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে অতি চালাকী করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়ে যান। গণমাধ্যমে বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। তারা সংশ্লিষ্ট কোম্পানি খুলনা পাওয়ারের উদ্যোক্তাদের শেয়ার লেনদেনে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাতে ভেস্তে যায় আজিজ খানের পরিকল্পনা।
ঘটনাটি ২০১৮ সালের। ওই বছরের ৪ নভেম্বর তালিকাভুক্ত খুলনা পাওয়ার কোম্পানির অন্যতম উদ্যোক্তা-শেয়ারহোল্ডার সামিট মার্কেন্টাইল করপোরেশন লিমিটেড পাবলিক মার্কেটে খুলনা পাওয়ারের ১ কোটি ৮০ লাখ ৬৪ হাজার ২৩৫টি শেয়ার বিক্রি করার ঘোষণা দেয়। সামিট মার্কেন্টাইল হচ্ছে আজিজ খানের পরিবারের মালিকানাধীন কোম্পানি। এ ঘোষণায় বাজারে তোলপাড় শুরু হয়। দেখা দেয় চরম অস্থিরতা। তাতে শুধু খুলনা পাওয়ারের শেয়ার নয়, পুরো বাজারই বড় দরপতনের মুখে পড়ে।
সামিটের শেয়ার বিক্রির ঘোষণায় কিছু রহস্যের আভাস দেখা যাওয়ায় অর্থসূচক তার অনুসন্ধানে নামে। সাধারণতঃ কোনো বড় অংকের শেয়ার কেনা-বেচা করতে চাইলে তা পাবলিক মার্কেটে না করে ব্লক মার্কেটে করা হয়ে থাকে। কারণ পাবলিক মার্কেটে প্রত্যাশিত দামে শেয়ার কেনা-বেচা করার জন্য বিক্রেতা ও ক্রেতা পাওয়া যায় না। জেনেশুনে সামিট মার্কেন্টাইল পাবলিক মার্কেটে প্রায় দু’কোটি শেয়ার বিক্রির ঘোষণা স্বাভাবিক কারণেই নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।
প্রথমেই যে প্রশ্নটি আমাদের মাথায় আসে, খুলনা পাওয়ারের কী কোনো খারাপ খবর আছে, যে কারণে সামিট গ্রুপ কোম্পানিটি থেকে তাদের মালিকানার অংশ কমাতে চাচ্ছে? এমন কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আছে কী, ব্লক মার্কেটে শেয়ার বিক্রি করতে চাইলে যা প্রকাশ হয়ে যেতে পারে? ব্লক মার্কেটে যারা বড় অংকের শেয়ার কিনে থাকেন, সাধারণত তাদের নেটওয়ার্কও বড় হয়। তাই বড় কোনো বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের আগে তারা কোম্পানির নানা গোপন তথ্য জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেন। পাবলিক মার্কেটের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে এ ধরনের তথ্য জানা বেশ কঠিন।
অর্থসূচকের অনুসন্ধানে জানা যায়, খুলনা পাওয়ার কোম্পানির প্রথম বিদ্যুৎকেন্দ্রটির (ইউনিট-১) বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরকারের কাছে বিক্রির অনুমতি প্রায় এক মাস আগে ১২ অক্টোবর শেষ হয়ে গেছে। এই কেন্দ্রটির উৎপাদনক্ষমতা ১১০ মেগাওয়াট। খুলনা পাওয়ার কোম্পানির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা তখন ছিল ২৬৫ মেগাওয়াট। ইউনিট-১ এর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোম্পানিটির বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা কমে ১৫৫ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে। উৎপাদনক্ষমতা কমেছে প্রায় ৪২ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রির পরিমাণ ৪২ শতাংশ কমে যাওয়ায় কোম্পানির মুনাফাও ব্যাপকভাবে কমে যাবে। তাতে শেয়ারের দামেও ধস নামবে। এ বাস্তবতায় তথ্য গোপন রেখে ১ কোটি ৮০ লাখ শেয়ার বিক্রি করার উদ্যোগ নেয় আজিজ খানের সামিট মার্কেন্টাইল।
আইন লংঘন করে আজিজ খানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা যোগায় খুলনা পাওয়ার কর্তৃপক্ষ। সিকিউরিটিজ আইন অনুসারে, প্রতিটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির উপর সব ধরনের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা আছে। কোম্পানির ৪২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা কমে যাওয়া সত্ত্বেও এ তথ্য প্রকাশ করেনি খুলনা পাওয়ার কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। আজিজ খানের শেয়ার বিক্রি সহজ করতে এমন গুরুত্বপূর্ণ মূল্য সংবেদনশীল তথ্য তারা গোপন করে যায়।
অনুসন্ধানে তথ্য গোপন ও প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি চেষ্টার প্রমাণ পাওয়ায় ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর ‘১১০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ, অসৎ উদ্দেশ্যে তথ্য গোপন কেপিসিএলের‘ এবং ২০ নভেম্বর ‘২ কোটি স্পন্সর-শেয়ার বিক্রিতে সুবিধা দিতে কেপিসিএলের আইন লঙ্ঘন! শিরোনামে দুটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট প্রকাশের পর বাজারে তোলপাড় শুরু হয়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে কোম্পানিটির কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা দাবি করে, রিপোর্টের বিষয়টি সঠিক নয়। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কোম্পানির বক্তব্যে বিশ্বাস না করে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চিঠি দেয়। জবাবে মন্ত্রণালয় খুলনা পাওয়ারের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি কমিশনকে নিশ্চিত করে। এর প্রেক্ষিতে বিএসইসি পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত খুলনা পাওয়ার কোম্পানির উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি, হস্তান্তর, উপহার দেওয়া, জামানত রাখায় নিষেধাজ্ঞা আপোর করে। তাতেই ভেস্তে যায় সামিটের ২শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র। ওই নিষেধাজ্ঞা এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়নি।
সামিট মার্কেন্টাইল যখন শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিল, তখন বাজারে খুলনা পাওয়ারের শেয়ারের দাম ছিল ১২০ টাকা। তাতে ১ কোটি ৮০ লাখ ৬৪ হাজার ২৩৫টি শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ২১৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বর্তমানে বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ১১ টাকা ৭০ পয়সা। তাতে ওই শেয়ারের মোট মূল্য দাঁড়ায় মাত্র ২১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। যা ওই সময়ের মূল্যের চেয়ে ১৯৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা কম।
এ ঘটনায় বিএসইসি তখন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। তবে তদন্ত রিপোর্ট কখনোই প্রকাশ করেনি তারা। এমন ভয়াবহ জালিয়াতি চেষ্টার ঘটনায় আজিজ খান, সামিট মার্কেন্টাইল এবং খুলনা পাওয়ার কোম্পানির কারো বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন।
আপনার মতামত জানানঃ