সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অন্যায় অনিয়ম আর দুর্নীতির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ লঘু শাস্তি দিয়ে দফারফা করে থাকেন বলে অভিযোগ তুলেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের অপকর্মের ব্যাপারে আদালত কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নমনীয় আচরণ প্রকাশ করেন বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন।
সম্প্রতি ডাক অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (সরবরাহ ও পরিদর্শন) মো. ফয়জুল আজিমের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তার দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) স্থগিত করা হয়েছে। অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অতিরিক্ত ডিজি) ফয়জুল আজিমকে এই লঘুদণ্ড দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে সম্প্রতি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব মো. আফজাল হোসেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ডাক অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (সরবরাহ ও পরিদর্শন) মো. ফয়জুল আজিম ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলের পোস্টমাস্টার জেনারেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ওই দায়িত্ব পালনকালে নোয়াখালী বিভাগের খিলপাড়া ও দত্তপাড়া ডাকঘরে যথাক্রমে ২০ কোটি ও ৩৮ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে।
এতে বলা হয়, তার কর্মকালে সাব পোস্টমাস্টার নূর করিম ও মিজানুর রহমান পোস্টমাস্টারকে ২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর যথাক্রমে নোয়াখালী বিভাগের কড়িহাটি ডাকঘর ও খিলপাড়া ডাকঘরে সাব পোস্টমাস্টার হিসেবে পারস্পরিক বদলি করা হলেও তারা কর্মস্থল পরিবর্তন না করে শুধু কাগজের মাধ্যমে দায়িত্ব হস্তান্তর ও গ্রহণ করেন। অভিযুক্ত কর্মচারী নূর করিম ১৯৯৯-২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের প্রায় ১৬ বছর একই ডাকঘরে দায়িত্ব পালন করেছেন, যা তার (ফয়জুল আজিম) নজরে আসেনি।
ফয়জুল আজিম চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলের পোস্টমাস্টার জেনারেল পদে থাকাকালীন তার আওতাধীন নোয়াখালী বিভাগের পরিদর্শন কার্যক্রম যথানিয়মে পালন করলে এ আত্মসাতের ঘটনা ঘটতো না এবং তার এমন কর্মকাণ্ড কর্তব্যে চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় প্রকাশ পায়, যা অসদাচরণের সামিল বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।
এই অপরাধে ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগে ফয়জুল আজিমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয় জানিয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী পাঠিয়ে তাকে কারণ দর্শাতে বলা হয়। ফয়জুল আজিমের লিখিত এবং ব্যক্তিগত শুনানিতে দেয়া বক্তব্য সন্তোষজনক প্রতীয়মান হয়নি এবং সার্বিক পর্যালোচনায় তাকে লঘুদণ্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা তৎকালীন চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলের পোস্টমাস্টার জেনারেল ফয়জুল আজিমের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার লঘু অভিযোগ তোলা হয়েছে এবং একইসাথে এতো টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তাকে শাস্তিও দেওয়া হয়েছে লঘু বলে মনে করেন। তারা মনে করেন, ফয়জুল করিমের পেছন থেকে এতো টাকা আত্মসাৎ হয়ে গেলো আর তিনি কোনো টেরই পাননি, বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক নয়। একইসাথে তার অধীনে এতোটি বছর কাজ করার পরও তিনি তাদের বদলি বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন না, বিষয়টা ব্যাপক সন্দেহের জন্ম দেয়। যথাযথ তদন্ত করলে টাকা আত্মসাতের সাথে তার নাম পাওয়া যেতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বিচার প্রার্থী এক নারীকে শ্লীলতাহানি ও যৌন নির্যাতনে অভিযুক্ত বিচারক কনক বড়ুয়াকে তার চাকরিস্থল থেকে বদলি করে লঘু শাস্তি দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। গতকাল মঙ্গলবার(১৯ জানু) আইন মন্ত্রণালয় (আইন ও বিচার বিভাগ) থেকে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ঢাকা চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কনক বড়ুয়াকে বর্তমান কর্মস্থল হতে প্রত্যাহার করে আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হলো।
জানা যায়, গত ১২ জানুয়ারি কনক বড়ুয়ার বিরুদ্ধে ‘মামলা আমলে না নেওয়া এবং মামলার বাদী ভুক্তভোগী নারীকে পুলিশি হয়রানির ভয় দেখিয়ে খাস কামরায় শ্লীলতাহানি’র অভিযোগ উঠেছে। মুখ্য মহানগর হাকিম, জেলা জজ ও আইনজীবী সমিতিতে বিচারপ্রার্থী ওই নারী লিখিত অভিযোগে বলেন, ‘সাক্ষ্যের জন্য নির্ধারিত দিন থাকায় তিনি আদালতে হাজির হন। এ সময় বিচারকের খাস কামরায় গেলে বিচারক কনক বড়ুয়া ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন। এরপর তিনি জোর করে বোরকা খুলে ফেলেন এবং শরীরের স্পর্শকাতর অংশে হাত দেন।’
বিচারপ্রার্থী নারীকে বিচারক কর্তৃক যৌন নির্যাতনের এহেন লঘু শাস্তিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহল। তারা মনে করেন, বিচারকের কাছে বিচার চাইতে আসা নারীর যৌন নির্যাতন যেমন গুরুতর অপরাধ, একজন বিচারক কর্তৃক বিচার প্রার্থীর এমন আচরণ তেমনি গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু এসবের শাস্তি লঘু করে কোনো মতে বিচার সমাধা করাকে সমাজে ভিন্ন বার্তা পৌঁছাতে পারে বলে মনে করেন। এমনিতে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজে জড়িত বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পাওয়া যায়, রক্ষক হয়ে ভক্ষকের মতো ঘটনাও ঘটে, সেখানে এমন অপরাধ রোধে লঘু শাস্তি তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা বলে মনে করেন না সংশ্লিষ্ট মহল।
এদিকে ‘দুর্নীতির বলয়’ ভাঙতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন ২৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদক মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে এদের মধ্যে ২২ জনকেই কেবল দেশের বিভিন্ন জায়গায় বদলি করেছিল সরকার। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. ফারুক হাসান শাস্তির বদলে পেয়েছেন পুরস্কার। তাকে রাজধানীর মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়েছে। আর এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দুর্নীতির অভিযোগে বদলি হওয়া কর্মকর্তাকে আবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রধান কার্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্বে আনার মাধ্যমে অধিদপ্তরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নিজের অপকর্মে সহায়তার পুরস্কার দিয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজকে স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণকারী কার্যালয়ে পদায়নের ফলে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। দুদক স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতিবাজ যে ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল তাতে ফারুক হাসানের নাম ছিল দ্বিতীয় নম্বরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ফারুক হাসানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দুদক তদন্ত করছে এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তিনি অনিয়ম, দুর্নীতি এবং নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রণালয় তাকে ফিরিয়ে এনে শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কৃত করেছে।’
জানা গেছে, ২৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল দুদক। ওই চিঠিতে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন কার্যালয়ে কিছু দুর্নীতিবাজ, স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মস্থলে চাকরি করার সুবাদে দুর্নীতির শক্তিশালী বলয় তৈরি হয়েছে। এদের কারণে অধিদপ্তরের সুশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চিঠিতে আরও বলা হয়েছিল, ‘দুর্নীতির বলয়’ তৈরি করা এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতার অপব্যবহার করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুদকের ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ কর্মকর্তাকে বদলি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, এমন উদাহরণ দেশে অনেক রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে লঘু শাস্তি কিংবা বদলি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থেকেছে। এতে দেশের দুর্নীতি, অনিয়ম আর ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে জটিলতা বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩২
আপনার মতামত জানানঃ