বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান বেড়েই চলেছে। বেসরকারি খাতের এসব শিল্পকারখানা লাভ করতে পারলে সরকারি খাতের কারখানাগুলো ক্রমাগত লোকসান দিয়েই যাচ্ছে। বিসিআইসি সংস্থার ১২টি কারখানায় সার, সিমেন্ট, কাগজ, স্যানিটারি পণ্য ও গ্লাস উৎপাদন করে কোটি কোটি টাকা লাভ করে যাওয়ার কথা থাকলেও এখন বছরে হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনছে প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পরিচালনা পর্ষদের অদক্ষতা, গাফিলতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই ডুবেছে বিসিআইসি এবং এর অধীনের প্রতিষ্ঠানগুলো।
তথ্য বলছে, গত অর্থবছর বিসিআইসির ১০টি প্রতিষ্ঠান লোকসান করেছে। একটি প্রতিষ্ঠান লাভজনক; আরেকটি প্রতিষ্ঠান লোকসানও নয় লাভও নয় এমন পরিস্থিতিতে চলছে। এর মধ্যে বিসিআইসির আটটি সার কারখানার ছয়টিই লোকসানি। এছাড়া লোকসান হয়েছে সিমেন্ট, কাগজ, স্যানিটারি পণ্য ও গ্লাস উৎপাদনের পৃথক চারটি কারখানায়।
আলোচিত সময়ে শুধু টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেড সার উৎপাদনে ২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা লাভ করেছে। ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানির লাভ-লোকসান সমান ছিল।
তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের (২০১৯-২০) মে মাস পর্যন্ত এসব কারখানায় লোকসান হয়েছে ৮১৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তবে পুরো অর্থবছরের তথ্য এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। পুরো বছরে এ লোকসানের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সূত্র জানিয়েছে। এ পর্যন্ত লোকসানের পরিমাণও বিসিআইসির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
এদিকে সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লাভজনক ছিল সংস্থাটি। ওই বছর ৯৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা লাভ হয়েছিল। এর পরের বছর লোকসান হয় ৭৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এরপর থেকে লোকসান ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
শেষ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি লোকসান করেছে শাহজালাল ফার্টিলাইজার। মে মাস পর্যন্ত ২৬৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা লোকসান করে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি ১৭৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা, চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড ১৪৫ কোটি ৬৩ লাখ, আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি ৭১ কোটি ৭৫ লাখ, যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি ৬২ কোটি ২৬ লাখ, পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি ৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা লোকসান করে। অন্যদিকে একই সময়ে ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি ৩৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, কর্ণফুলী পেপার মিল ২০ কোটি ১৩ লাখ, বাংলাদেশ ইন্সুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরি ১৯ কোটি ১৭ লাখ এবং উসমানীয় গ্লাস ফ্যাক্টরি ১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে।
সংস্থাটির পরিচালক (বাণিজ্যিক) ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আমিন উল আহসান বিসিআইসির লোকসানের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখেন ‘ট্রেডিং গ্যাপ’কে। সম্প্রতি জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘কৃষককে স্বল্পমূল্যে সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারের নেয়া উদ্যোগের সহায়তা করছে বিসিআইসি। এ কারণে প্রতি টন সার গড়ে ২২ হাজার টাকায় উৎপাদন করে ১৪ হাজার টাকায় সরবরাহ করছি। এটি লোকসানের বড় কারণ।’
আমিন উল আহসান আরও বলেন, ‘প্রতি বছর বিসিআইসি আট থেকে নয় লাখ টন সার সরবরাহ করছে ন্যায্যমূল্যে। এ প্রতিষ্ঠান কৃষিতে বড় ভূমিকা রাখছে। এটি একটি সর্বসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান। আমরা সরকারের জন্য কাজ করছি। যোগ-বিয়োগ করে দেখলে বিসিআইসি কখনো লোকসান করছে না। তারপরও আমরা আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে এ লোকসান কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’
যদিও বিসিআইসির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার অভিযোগ, আগের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের অদক্ষতা, গাফিলতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই ডুবছে বিসিআইসি এবং এর অধীনের প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে হতাশায় আছেন এখানকার আট হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী।
স্বাধীনতার পর সরকারের ঘোষিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং কিছুটা বাধ্য হয়ে উল্লিখিত শিল্পকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছিল। কেননা, এসব শিল্পকারখানার অধিকাংশেরই মালিক ছিলেন পাকিস্তানিরা। সরকারের ভুল নীতি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এসব কারখানা কখনোই লাভজনক হয়নি। তাই ৫০ বছরের নির্মম বাস্তবতা হলো, লোকসানের দায়ে আদমজীসহ বহু কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বহু কারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে ভুয়া উদ্যোক্তা সেজে কারখানা কেনার নামে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে লোপাট করে দিয়েছেন। তবে এর মধ্যেও বেসরকারি অনেক উদ্যোক্তা শিল্পকারখানাকে লাভজনক করতে পেরেছেন, যার মূল শক্তি হলো সততা ও দক্ষতা।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বেসরকারি খাতের এসব শিল্পকারখানা লাভ করতে পারলে সরকারি খাতের কারখানাগুলো কেন ক্রমাগত লোকসান দিয়ে যাবে? সার্বিকভাবে ক্রমবর্ধমান এ লোকসানের কারণ হিসেবে বিসিআইসির কারখানাগুলোর বেশি বয়স, দক্ষ জনবলের অভাব, চলতি মূলধনের ঘাটতি, কারখানা সংস্কারের অভাব ও আধুনিকায়ন বা বিএমআরই (ব্যালান্সিং, আধুনিকায়ন, বিস্তার ও প্রতিস্থাপন) না করাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বেতন বৃদ্ধি এবং উৎপাদন উপকরণ ও গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করছেন অনেকে। একইসাথে রয়েছে অদক্ষ সিদ্ধান্ত ও দুর্নীতির অভিযোগও।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিচালনা পরিষদের স্বচ্ছতা থাকলে প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানটি অনায়াসেই লাভের দিকে হাঁটতে পারতো। সরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠানই লোকসানের পেছনে মোটা দাগে কাজ করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের গাফিলতি, অনিয়ম আর দুর্নীতি। সরকারের উচিত এসব প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা এনে লাভজনকের দিকে পাল তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া।
এসডব্লিউ/জেএন/কেএইচ/১৪৩৬
আপনার মতামত জানানঃ