২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে বগুড়ায় শ্রমিক লীগ নেতা ও তার সহযোগী কর্তৃক এক ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর মা ও ধর্ষিতা ছাত্রীর মাথা ন্যাড়া ও নির্যাতনের ঘটনা গোটা দেশকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ঐ বছরেই প্রধান আসামী তুফান সরকারসহ তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তার সহযোগীরা জামিনে ছাড়া পেলেও জামিন পায়নি তুফান সরকার। দীর্ঘ চার বছর পর গত রবিবার মামলার প্রধান আসামি বহিষ্কৃত শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারকে জামিন দেন আদালত। আদালতে বাদীরা সাক্ষ্য দেন যে, ভুল-বোঝাবুঝির কারণে এই মামলা হয়। অর্থাৎ বাদী ধর্ষণের ঘটনা অস্বীকার করে সাক্ষ্য দেন। যার ফলে আদালত আসামি তুফান সরকারকে ধর্ষণের মামলা থেকে জামিন দেন। এখন জানা গেছে যে, ৪০ লক্ষ টাকার মাধ্যমে নিজেদের মাঝে আপস করে বাদী আদালতে এই মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ছলে–বলে–কৌশলে তুফানের পরিবার ওই মা এবং মেয়েকে আপসে বাধ্য করে। ৪০ লাখ টাকা চুক্তিতে মা ও মেয়ে আদালতে গিয়ে উল্টো সাক্ষ্য দিতে সম্মত হন। বিষয়টি ওই ছাত্রী ও তার মা স্বীকারও করেছেন।
প্রথম আলোর মাধ্যমে জানা যায়, ওই ছাত্রীর মা ও মামলার বাদী বলেন, মেয়েকে তিনি অন্যত্র বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে এখন সংসার করছেন। কারাগারে থাকা মামলার প্রধান আসামি তুফান সরকারের পরিবারের অনুরোধে ৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে মীমাংসা করতে রাজি হয়েছেন তারা। মামলা আপস করার শর্তে তারা ইতিমধ্যেই (সাক্ষ্যের আগে) অর্ধেক টাকা দিয়েছেন। অবশিষ্ট টাকা এখনো হাতে পাননি তিনি।
মামলার অভিযোগ গঠনের পর আপসের সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে মামলার বাদী বলেন, ‘সেটা আসামিপক্ষের বিষয়। সাক্ষ্য না দিলে বা কিংবা দুর্বল সাক্ষ্য দিলে মামলা এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ধর্ষণ এবং মাথার চুল ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনায় দুটি মামলা চলমান। শুধু তুফান সরকারের কাকুতি–মিনতিতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে বিচারাধীন ধর্ষণ মামলাটি আপসে রাজি হয়েছেন তারা। চুল কেটে মাথা ন্যাড়া ও নির্যাতন করার ঘটনায় অন্য আদালতে বিচারাধীন মামলাটিতে তারা আপস করবেন না।
ঘটনার শিকার ওই ছাত্রী বলেন, ‘আমার জীবনে যে ক্ষতি হয়েছে, তা আর ফিরে পাব না। এখন বাকিটা জীবন ভালোভাবে বাঁচতে চাই। বিয়ে করেছি, সংসার করছি। দুটো মামলার মধ্যে ধর্ষণ মামলা আপসে মা রাজি হয়েছেন। তবে তুফান কত টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন, সেটা আমি জানি না।’
আদালতের বাইরে অর্থের বিনিময়ে আপস প্রসঙ্গে বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১–এর রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আইনজীবী নরেশ মুখার্জি বলেন, ‘মামলার এ পর্যায়ে আদালতে আপসের কোনো সুযোগ নেই। তবে আদালতের বাইরে কোনো কিছু হয়ে থাকলে, তা আমাদের জানা নেই।’
এজাহার সূত্র জানা যায়, তুফান সরকার এক ছাত্রীকে বগুড়ার ভালো কলেজে ভর্তি করে দেবার নামে তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। গত ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই সহযোগিদের মাধ্যমে ওই ছাত্রীকে তার বগুড়া শহরের চকসুত্রাপুর চামড়া গুদাম এলাকার বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করেন। তার স্ত্রী আশা সরকার বিষয়টি জানতে পেরে বোন বগুড়া পৌরসভার ২ নম্বর সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর মারজিয়া হাসান রুমকির সঙ্গে পরামর্শ করে উল্টো ওই ছাত্রীকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করেন। ওই বছরের ২৮ জুলাই ওই ছাত্রী ও তার মাকে ক্যাডারের মাধ্যমে তুলে শহরের বাদুড়তলার বাড়িতে আনা হয়। সেখানে মা ও মেয়েকে রড দিয়ে মারপিট, শ্লীলতাহানী এবং নাপিত ডেকে দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। এছাড়া তাদের অবিলম্বে বগুড়া ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এক প্রতিবেশি ওই মা ও মেয়েকে উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
বিষয়টি জানাজানি হলে পুরো জেলায় তোলপাড় শুরু হয়। ছাত্রীর মা ২৮ জুলাই সদর থানায় তুফান সরকারসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন। পুলিশ একজন ছাড়া সকল আসামিকে গ্রেফতার করে। তুফান সরকার ছাড়া আসামিদের প্রায় সকলে আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পান। গত রোববার(১৭ জানু) মামলার প্রধান আসামি বহিষ্কৃত শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকার আদালতে জামিন আবেদন করলে বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত-১–এর বিচারক এ কে এম ফজলুল হক আলোচিত এই মামলার প্রধান আসামি তুফান সরকারের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, মামলার প্রধান সাক্ষী বাদী নিজেই। এ ছাড়া ভিকটিম মেয়েটিও মামলার অন্যতম সাক্ষী। রোববার প্রধান আসামির জামিন শুনানির আগে মামলার গুরুত্বপূর্ণ এই দুই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এ সময় আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মা-মেয়ে দুজনই বলেন, ঘটনার স্থান, কাল—কিছুই তারা জানেন না। তুফান সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগও নেই। কোনো ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেনি।
বাদী আরো বলেন, মামলার এজাহারে বর্ণিত অভিযোগ সত্য নয়। জোরজবরদস্তি করে মামলার এজাহারে তার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। এজাহারে কী লেখা আছে, সেটাও তিনি পড়ে দেখেননি। ভুল–বোঝাবুঝি থেকে এ মামলা হয়েছে।
তবে আলোচিত একটি মামলা এই পর্যায়ে এসে এভাবে রফাদফাকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখছেন না সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, দেশজুড়ে নাড়া দেওয়া একটি আলোচিত ধর্ষণ মামলার পৌনে চার বছর পর আদালতে দাঁড়িয়ে ঘটনা সত্য নয়, বাদীর এ ধরনের সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। বাদী আসামি কর্তৃক টাকায় রফাদফা করতে রাজী হতে বাধ্য হয়েছেন কিনা এবিষয়ে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান তারা। একইসাথে আলোচিত এবং স্বীকৃত এমন একটি ঘটনা ঘটিয়েও আসামিরা পার পেয়ে গেলে সমাজে একটি নেতিবাচক বার্তা ছড়াবে। দেশ থেকে এমনিতে ধর্ষণ মামলাগুলোর যথাযথ বিচার ব্যবস্থা সম্পন্ন হয় না। তার মধ্যে এমন আপস করে মামলা চুকিয়ে নেওয়াতে দেশে ধর্ষণ রোধে সমস্ত আইন ভেস্তে যাবে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/পিএ/কেএইচ/২১১২
আপনার মতামত জানানঃ