আগামীকাল(২০ জানুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠান। এদিনকে ঘিরে সারা বিশ্বে চলছে টান টান উত্তেজনা। গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা এই উত্তেজনায় আরো ঘি ঢেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদের একেবারে শেষ সময়ে এসে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে সশস্ত্র মহড়া দিয়েছে তার উগ্রপন্থি সমর্থকরা। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য আইনসভার (স্টেট হাউজ) সামনে বিক্ষোভকারীদের ছোট ছোট দল দেখা যায়, ছোট ছোট দলে জড়ো হওয়া প্রতিবাদকারীদের কিছু অংশ ছিল সশস্ত্র। এফবিআই আগে থেকেই সতর্ক করে আসছিল, নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক সামনে রেখে ফের সশস্ত্র বিক্ষোভ হতে পারে। এখন আমেরিকার জনগণসহ গোটা বিশ্বই উদ্বিগ্ন, কী হতে যাচ্ছে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশটির।
রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলে সৃষ্ট দাঙ্গায় পাঁচজন নিহত হওয়ার পর রোববার রাজ্যপরিষদগুলো ঘিরে সশস্ত্র প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকরা। এ নিয়ে তীব্র উত্তেজনা দেখা যায়। ৫০টি রাজ্য কর্তৃপক্ষ ন্যাশনাল গার্ড সেনাদের মোতায়েন করে। ওয়াশিংটনে ১৫ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র যত সেনা মোতায়েন করেছে, এদিন তার চেয়ে বেশি ছিল ওয়াশিংটনে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ওহাইও অঙ্গরাজ্যের কলম্বাসের স্টেট হাউজের সামনে বুগালু বয়েজ আন্দোলনের ২৫ জনের মতো সদস্য ভারী অস্ত্র নিয়ে জড়ো হয়। তবে সরকার উৎখাতে উদ্যোগী চরমপন্থি গোষ্ঠীটি বলেছে, তাদের এই জমায়েত ছিল আগ্নেয়াস্ত্রের অধিকারের পক্ষে অনেক আগে পরিকল্পনা করা একটি সমাবেশ।
মিশিগানে ২০-২৫ জনকে দেখা যায় ল্যানসিংয়ের স্টেট হাউজের সামনে বিক্ষোভ করতে। এদের কয়েকজনের হাতে ছিল রাইফেল। ডজনখানেক বিক্ষোভকারীর একটি ছোট দল জড়ো হয়েছিল অস্টিন শহরে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ক্যাপিটলের সামনে। এদেরও কয়েকজনের হাতে রাইফেল দেখা যায়।
এদিকে নিরাপত্তারক্ষীদের অভ্যন্তর থেকেও হামলা আসতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, প্রতিরক্ষা ও পেন্টাগনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আশঙ্কা—নিরাপত্তায় নিয়োজিত ন্যাশনাল গার্ডের ২৫ হাজার ও পুলিশ সদস্যদের মধ্যে থাকা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী কেউ ভেতর থেকে হামলা করে বসতে পারে। এমন আশঙ্কার ভিত্তি হচ্ছে ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে হামলার সময় দেখা গেছে ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরা হামলাকারীদের স্বাগত জানাচ্ছেন। ওই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ক্যাপিটল পুলিশের অর্ধডজন সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আরও একডজনের মতো তদন্তাধীন আছেন।
ভেতর থেকে হামলার আশঙ্কার মধ্যেই নিউ জার্সিতে গ্রেফতার করা হয়েছে আর্মির রিজার্ভ সেনা ৩০ বছর বয়সি টিমোথি হেইল-কুসানেলিকে। তিনি উগ্র ট্রাম্প-সমর্থক দাঙ্গাকারীদের ‘অগ্রসর’ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে অভিযোগ। টিমোথির বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী মানসিকতার অভিযোগ আনা হয়েছে। তার হাতে রয়েছে সিক্রেট সার্ভিসের নিরাপত্তা ছাড়পত্র। এ কারণে ন্যাশনাল গার্ড ও পুলিশে থাকা একই মনোভাবাপন্নদের নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
আর্মি সচিব রায়ান ম্যাকার্থি বলেন, ‘কর্মকর্তারা সম্ভাব্য হুমকির আশঙ্কা করছেন। ফলে সেনা কমান্ডারদের অভ্যন্তরীণ সব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অভিষেকে কীভাবে নিরাপত্তা দেওয়া হবে—বিষয়টি নিয়ে প্রস্তুতিমূলক মহড়া সম্পর্কে অন্য সামরিক নেতাদের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। সম্ভাব্য অভ্যন্তরীণ হামলা মোকাবিলায় ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।’
অভিষেকের মূল নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে মার্কিন সিক্রেট সার্ভিস। কিন্তু সেইসঙ্গে সেনা সদস্য ও আইনপ্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থার সদস্যও থাকবেন। ন্যাশনাল গার্ড থেকে এফবিআই, ওয়াশিংটন মেট্রোপলিটন পুলিশ, ইউএস ক্যাপিটল পুলিশ ও ইউএস পার্ক পুলিশ একযোগে নিরাপত্তার কাজ করবে।
আগামীকাল বুধবার বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানের আগে রোববার দেশজুড়ে সশস্ত্র প্রতিবাদ হতে পারে বলে এফবিআই সতর্ক করেছিল। সহিংস প্রতিবাদের আশঙ্কায় বহু নগর কর্তৃপক্ষ ব্যাপক নিরাপত্তা প্রস্তুতি গ্রহণ করে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের অভিষেক সামনে রেখে ওয়াশিংটন ডিসির অধিকাংশ এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। রাজধানীতে ন্যাশনাল গার্ডের হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সিক্রেট সার্ভিসের অনুরোধে ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল মল বন্ধ রাখা হয়েছে। রাজধানীর সড়কগুলোতে ব্যারিকেড বসিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। অভিষেকের দিন নিরাপত্তায় থাকবে ২৫ হাজার সেনা। রাজধানীকে একটি দুর্গে পরিণত করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে বাইডেনের টিম যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে কভিড-১৯ মহামারির মধ্যে রাজধানীতে না আসার আহ্বান জানিয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসির মেয়রসহ স্থানীয় কর্মকর্তারা জনগণকে নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠান দূর থেকে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ৬ জানুয়ারির চেয়ে ভয়ানক কোনো ঘটনা ঘটতে পারে বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানের দিনটিতে। ট্রাম্প সমর্থকদের সশস্ত্র বিক্ষোভ জারি আর নিরাপত্তাকর্মীদের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ট্রাম্প সমর্থকদের হাত ধরে আমেরিকার ইতিহাসের ভয়ানকতম ঘটনার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। ইতিমধ্যেই দেশটিতে এক আতঙ্কময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যেমন পরিস্থিতি সাধারণত কোনো যুদ্ধাক্রান্ত দেশগুলোতে দেখা যায়। ট্রাম্প সমর্থকদের আগ্রাসী ভূমিকা আমেরিকাকে কোন দিকে নিয়ে যেতে পারে, এবিষয়ে বিশ্ব যেমন উদ্বিগ্ন, একইসাথে উদ্বিগ্ন রয়েছে দেশটির প্রশাসন ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোতেও। ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা এবং তাদের দ্বারা উদ্ভব পরিস্থিতি ইতিমধ্যে বিশ্বের আদর্শ গণতন্ত্রের ঝাণ্ডাবাহী আমেরিকার গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, এখন আগামীকাল বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানকে ঘিরে কী হতে পারে, তার ওপর আমেরিকাকে দ্বিতীয়বার খাঁদে পড়ার আশঙ্কা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে জোর গলায় গণতন্ত্র লালনের চিৎকার দমনের আশঙ্কাও।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/ ১৫৪৯
আপনার মতামত জানানঃ