কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তা সবার জন্যই দুঃখজনক ও লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। মঙ্গলবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। আদালত আরও বলেন, সংবিধান ও আইনে সব বিষয় লেখা আছে। কিন্তু আমরা কেউ সংবিধান, আইন মেনে চলছি না।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন, এডভোকেট জেড আই খান পান্না, ব্যারিস্টার অনিক আর হক ও এডভোকেট মানজুর আল মতিন প্রীতম। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মো. মোরসেদ ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদী হাছান চৌধুরী।
গতকাল সকালে আন্দোলনকারীদের ওপর তাজা গুলি ব্যবহার না করার নির্দেশনা চাওয়ার রিটের শুনানি দ্বিতীয় দিনের শুনানি হয়। প্রথমে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী অনিক আর হক শুনানি শুরু করেন। অনিক আর হক এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় নারায়ণগঞ্জে বাসার ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছয় বছরের শিশু রিয়ার মৃত্যু হয়। এ সময় আদালত বলেন, এসব মৃত্যু আমাদের সবার জন্যই দুঃখজনক। একটা জীবন যখন চলে যায়, তখন কোনো পক্ষ থাকে না। আর এটা ছয় বছরের একটি শিশুর মৃত্যু! এক পর্যায়ে আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, আমরা কোর্টে ইমোশনাল বিষয় অ্যাড্রেস করবো না।
আমরা খুব লজ্জিত। পরে আইনজীবী অনিক আর হক আদালতকে বলেন, পুলিশকে যদি গুলি চালাতেই হয়, তবে পা লক্ষ্য করে গুলি করতে হবে। রাতে ডাকাত ধরার ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে শুধু সরাসরি গুলি করতে পারবে। এরপর আদালত বলেন, আমাদের এমন কোনো কাজ করা উচিত না, যাতে জাতির ক্ষতি হয়।
জবাবে অনিক আর হক বলেন, জাতির ক্ষতি বলতে শুধু কিছু ভবন, স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি বোঝালে হবে না। জীবনের ক্ষতিও জাতির ক্ষতি। আগে বিক্ষোভ দমন বা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গরম পানি, মরিচের গুঁড়া ব্যবহার করতো। আদালত তখন বলেন, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ব্যবহার করা যেতে পারে। তার আগে মাইকিং করে সতর্ক করতে হবে। আমরা কেউই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছি না। পুলিশ কখন আর্মি কল করতে পারে সেটিও আইনে বলা আছে। পুলিশকে যে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তার খবর ও ছবি খুব একটা প্রচারে আসেনি।
রিটকারীর পক্ষে আইনজীবী সারা হোসেন আদালতকে বলেন, আইন কর্তৃত্ব বহির্ভূতভাবে কাউকে এভাবে হেফাজতে রাখার সুযোগ নাই। আইনি ক্ষমতার বাইরে কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায় না। বলা হচ্ছে যে, তাদের আত্মীয়-স্বজনরা দেখা করতে পারছেন। কিন্তু তারা কার সঙ্গে দেখা করতে চান বা চান না, সেটা জানার কোনো সুযোগ নেই। তার মানে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ চলছে। এ সময় আদালত বলেন, একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে আটকাতে হবে। হয় রিমান্ডে নিতে হবে, নয় আদালতে তুলতে হবে।
এ সময় দু’পক্ষের আইনজীবীদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে এজলাসে শোরগোল শুরু হয়। এরপর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর। তিনি আদালতকে বলেন, ছয় সমন্বয়কের জীবনের ঝুঁকি ও হুমকির কারণেই ডিবি তাদের হেফাজতে নিয়েছে। তখন আদালত বলেন, তাদের যে মেরে ফেলবে- এই কথাটা তাদেরই বলতে হবে। সে তো আশ্রয় চায়নি। রিট আবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, রিট আবেদনকারীরা ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য এসেছেন। তারা একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। এখানে যারা এসেছেন তারা সবাই এই কমিশনের সদস্য। তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।
এটি জনস্বার্থের আবেদন না, ব্যক্তি স্বার্থের আবেদন। তারা বলেছে ২০০-এর বেশি মারা গেছে। তারা কীভাবে জানলেন? আমরা দেখেছি পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। ১২শ’ পুলিশ সদস্য আহত। ১০০ পুলিশ সদস্যের মাথায় চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কোপ দেয়া হয়েছে। গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান রিট আবেদনকারীর একজনের বাবা। জাতিসংঘের একটি সনদ উদ্ধৃত করে তিনি আদালতকে বলেন, বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। ওই সনদ অনুসারে অনুপ্রেক্ষিত ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারীরা গুলি চালাতে পারবে। কোনটা অনুপ্রেক্ষিত পরিস্থিতি, সে সিদ্ধান্তও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেই নিতে হবে। এটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।
আইনজীবী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ৬ জন সমন্বয়কের স্বজনরা কেউ কোর্টে আসেনি। আদালত বলেন, যে কেউ আসতে পারে। নুরুল ইসলাম বলেন, স্বজনরা দেখা করেছেন। তাদেরকে রাখা হয়েছে কারণ তারা নিরাপত্তা চেয়েছেন। আদালত বলেন, আটক রাখতে হবে প্রক্রিয়ার ভেতরে। সুজন বলেন, তাদরকে তো নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছে। আজকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, উনাদের সহ্য হচ্ছে না। এই আবেদন গ্রহণযোগ্য না।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, আমরা আদালতের ভেতরে আছি। আইনের মধ্য থেকে কথা বলবো। এমন কিছু বলবো না, যাতে শুধু মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া যায়। আদালত তখন বলেন, বিষয়টি সব পক্ষেরই খেয়াল রাখা দরকার। এখন দেশে যে অবস্থা সে পরিস্থিতিতে ছয় সমন্বয়ককে পুলিশ আটকে রাখতে পারে কিনা। জবাবে আইন কর্মকর্তা মোরশেদ বলেন, দেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা কাকে কীভাবে রাখবে সে সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে।
শুনানি শেষে ব্যারিস্টার সারা হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা দেশের নাগরিক হিসেবে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি। এটি আমাদের নাগরিক উদ্যোগ। আর নাগরিক উদ্যোগ নেয়ার আমাদের সাংবিধানিক অধিকার আছে। হাইকোর্টের অন্য বেঞ্চ খোলা থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষের অনেক কর্মকর্তা এই বেঞ্চের শুনানিতে ছিলেন। তারা তাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন না করে সেখানে ছিলেন। আমরা যখন শুনানি করছিলাম তখন ঠিকমতো শুনানিও করতে পারছিলাম না। বাংলাদেশে এর আগেও অনেক গণতদন্ত কমিশন হয়েছে।
ঘৃণিত একুশে আগস্টের ঘটনার সময়ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। রিটকারী আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন বলেন, আমরা সোমবার অল্প সময়ের মধ্যে রিটটি রেডি করে আদালতে সাবমিট করেছি। আমরা বাবাদের রক্ষার জন্য নয়, শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষার জন্য এসেছি। আইনুন নাহার সিদ্দিকা বলেন, আমরা আমাদের পিটিশনে আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য আদেশ চেয়েছি। পুলিশ গুলি করবে করুক, তবে সেটা নিয়ম অনুযায়ী করুক। তারা আমাদের বাচ্চাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলছে।
গত সোমবার ডিবি হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতেও নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন নাহার সিদ্দিকা।
আপনার মতামত জানানঃ