বাধ্যতামূলকভাবে মুখে হাসি আনতে হবে। আর তাকে উপস্থাপন করা হবে বানোয়াট জয়ের হাসি হিসেবে। আসলে বিষয়টা হলো গাজা থেকে সরে আসা।
ইসরায়েল কয়েক দিনের মধ্যেই ঘোষণা দিতে যাচ্ছে যে হামাসের সামরিক শাখাকে গাজার মাটি থেকে উৎখাত করা হয়েছে। আর তাই যুদ্ধে ইসরায়েলের জয় হয়েছে। জয়? আপনি যদি তা-ই মনে করেন, তাহলে তা-ই। আমি তো বলব, গাজা থেকে সরে আসাটাই হলো আসল বিষয়।
হামাসের সেনাদল শেষ হয়ে গেছে, এটা ঘোষণা করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো, গাজা থেকে ইসরায়েলের বেশির ভাগ সেনাকে সরিয়ে নিয়ে পুবের সীমান্তে নিয়োজিত করা। আর তা গাজার মতো আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল বিজয় পেতে লেবাননে অভিযান চালানোর জন্য। তবে এই বিজয় লাভটা আগেরটার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ হবে। আর তাই আমরা আশা করতে পারি যে ইসরায়েল সেই সব ঘোষণাই দেবে, যা সরকারের, সেনাবাহিনীর, সাংবাদিকদের এবং এর নাগরিকদের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে তুলবে। তাই বলে এটা ভুললে চলবে না যে গাজা থেকে সরে আসাটাই হলো আসল বিষয়।
নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে গাজায় এখন পর্যন্ত কোনো বিজয় অর্জিত হয়নি, আগামী দিনেও হবে না। তবে যে রক্তভেজা গাছে ইসরায়েল উঠেছে, তা বেয়ে নিচে নামার জন্য একটা অজুহাত তো দরকার। কেননা, এই গাছ বেয়ে ওপরে ওঠাই তো উচিত হয়নি। সে জন্যই এখন একটা বানোয়াট বিজয় তৈরি করতে হবে।
একেকটি দিন অতিবাহিত হচ্ছে আর আমরা সেখানে আরও গভীরে ডুবে যাচ্ছি। বলুন যে আপনি রাফায় হামাসের গোটা সেনাদলকেই পর্যুদস্ত করেছেন। আর এটাই তো আমাদের পুরোপুরি বিজয় থেকে এক চুল দূরে সরিয়ে রেখেছিল। ইসরায়েলের ভেতরে ও বাইরে যা কিছু ঘটেছে, তা লুকিয়ে-ছাপিয়ে বিজয় ঘোষণা করতে হবেই। কেননা, গাজা ত্যাগ করাই যে মুখ্য।
নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে গাজায় এখন পর্যন্ত কোনো বিজয় অর্জিত হয়নি, আগামী দিনেও হবে না। তবে যে রক্তভেজা গাছে ইসরায়েল উঠেছে, তা বেয়ে নিচে নামার জন্য একটা অজুহাত তো দরকার। কেননা, এই গাছ বেয়ে ওপরে ওঠাই তো উচিত হয়নি। সে জন্যই এখন একটা বানোয়াট বিজয় তৈরি করতে হবে।
হামাস সামরিকভাবে প্রচণ্ড একটা আঘাত খেয়েও টিকে আছে। তার চেয়ে বড় হলো, অন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে জয়ী হয়েছে। অন্যদিকে কূটনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইসরায়েল পুরোপুরি না হলেও যথেষ্ট নাস্তানাবুদ হয়েছে। তারপরও দেশটির গণমাধ্যম প্রশংসার গীত গেয়ে চলেছে, যা ছলনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা আপনাদের ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডএফ) গাজা উপত্যকায় যেসব ‘চমৎকার কাজ’ করেছে, তার বিবরণ দিয়ে চলেছে।
ইসরায়েল তার সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ শুরু করার সময় যে অবস্থায় ছিল, যুদ্ধের শেষের দিকে এসে তার তুলনায় অপরিমাপযোগ্য খারাপ অবস্থায় পতিত হয়েছে। এমন নয় যে এই যুদ্ধের কোনো যৌক্তিকতা ছিল না, তবে যুদ্ধ তো এর ফলাফল দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। আর ফলাফলও আগাম জানা ছিল: দিশাহীনভাবে আটকা পড়া, এমনভাবে ফিলিস্তিনিদের রক্তপাত ঘটানো, যেন তা পানি; অনেক ইসরায়েলি সেনার রক্ত ঝরানো, ইসরায়েলকে একটি অচ্ছুত রাষ্ট্রে রূপান্তর করা এবং এ সবকিছুই কোনো প্রাপ্তি ছাড়া।
এই যুদ্ধের পেছনে ইসরায়েলের নিরন্তর যে বয়ান দাঁড়িয়ে আছে তা হলো, আর কোনো পথ নেই। ৭ অক্টোবরের পর আর কোনো পথ বা উপায় ছিল না, এখনো কোনো পথ নেই। এই মিথ্যাচার এখন পুব দিকে ধাবিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার করতে এবং গ্যালিলি থেকে সরে যাওয়া বাসিন্দাদের আবার তাদের ঘরবাড়িতে ফিরিয়ে আনতে আমাদের এখন লেবাননে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। অবশ্যই এ জন্য যা যা করার, তার সবই করতে হবে। তবে আগের চেয়ে ভয়াবহ আরেকটি সীমান্তে এসব কিছু করা যাবে না। আর এটাই একমাত্র পথ নয়।
গাজায় এখন তিনটি বিকল্প রয়েছে: সেখানে হামাসের শাসন চলতে দেওয়া (যদিও তা দুর্বলভাবে ও নজরদারির মধ্যে রেখে); গাজাকে আরেক সোমালিয়ায় পরিণত করা অথবা স্থায়ীভাবে ইসরায়েলি দখলদারির মধ্যে নিয়ে আসা। চতুর্থ কোনো বিকল্প নেই।
মন্দের ভালো হলো প্রথমটি, যা হতাশাজনক এবং ইসরায়েল ও গাজা উভয়ের জন্যই খারাপ। কিন্তু এর বিকল্প দুটি আরও খারাপ। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তবে হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে গাজা ত্যাগ করাই সবচেয়ে ভালো, যা যুদ্ধের অবসান ঘটাবে এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের ও কয়েক হাজার ফিলিস্তিনির মুক্তি বয়ে আনবে।
এ রকম একটা চুক্তি আগামীকালই হতে পারে, যা আগামী পরশু দিনের চেয়ে ভালো। আমাদের অবশ্য নিজেদের অহমিকা গিলে ফেলতে হবে, হামাসকে ক্ষমতায় রেখে দেওয়ার অপমান হজম করতে হবে এবং বিকল্পগুলোর মধ্যে কম মন্দ পথ হিসেবে গ্রহণের ঝুঁকি নিতে হবে। আমাদের, অবশ্যই দ্রুত এ কাজ সারতে হবে। আর তাহলেই আমরা পুব সীমান্তে (হিজবুল্লাহর সঙ্গে) একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে পারব।
এ জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই আমাদের, ইসরায়েলিদের করতে হবে। পুব সীমান্তে যুদ্ধের চেয়ে আর বড় কোনো বিপর্যয়ের সামনে ইসরায়েল দাঁড়িয়ে নেই। হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তি কেবল এই বিপর্যয় রোধ করবে।
আর ইসরায়েলেরে শেষ সৈনিকটি গাজা উপত্যকা থেকে সরে আসা না পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হবে না। সেনাবাহিনীর জেনারেলরা এবং টেলিভিশনের পর্দায় দেখা দেওয়া অতি আত্মবিশ্বাসী ভাষ্যকারেরা অবশ্য আমাদের এ রকম কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। বেশির ভাগ ইসরায়েলিও বিশ্বাস করেন না যে এমনটি হওয়া উচিত; কিন্তুই এটিই হলো বাস্তবতা।
যখন ইসরায়েলের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার প্রধান সতর্ক করে দেন যে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকলে ইসরায়েলে বসবাস করা সম্ভব হবে না, আর যখন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান যে তাঁরা গণকবর খননের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন তো যুদ্ধের দামামা বাজানো বন্ধ করা উচিত।
একই সঙ্গে প্রশ্ন করা উচিত, এটাই কী আমরা চেয়েছিলাম? আমরা কী টিকে থাকতে পারব? ৭ অক্টোবর ও গাজার আইডিএফ কি আমাদের আরেকটি বিজয় এনে দেবে? দয়া করে এ কথা বলবেন না যে আর কোনো উপায় নেই। উপায় একটা আছে। আর তা হলো সবকিছু সত্ত্বেও হামাসের সঙ্গে একটি সন্ধিতে উপনীত হওয়া এবং গাজা থেকে পুরোপুরি সরে আসা।
আপনার মতামত জানানঃ