টানা তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দিল্লি সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার শপথ অনুষ্ঠানের সাইড লাইনে ভারতের পুনঃনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন টানা চতুর্থ মেয়াদে বাংলাদেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শেখ হাসিনা। সেখানে বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশে সরকারের ধারাবাহিকতা থাকার বিষয়টি নিয়ে কথা হয়। সেইসঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অমীমাংসিত ইস্যুগুলো দ্রুত নিষ্পন্ন করার তাগিদ অনুভব করেন তারা। সোমবার ঢাকাগামী বিমানে ওঠার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গান্ধী পরিবারের সাক্ষাৎ হয়। সফরের পুরো সময় শেখ হাসিনা চাণক্যপুরীর আইটিসি মৌর্য হোটেলে ছিলেন।
দুপুরে সেখানে গিয়েই বাংলাদেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কংগ্রেস সংসদীয় দলের চেয়ারপার্সন সোনিয়া গান্ধী, কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী এবং দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াংকা গান্ধী। বৈঠকস্থলে উপস্থিত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যদের বয়ান এবং ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট মতে, দেখা হতেই গান্ধী পরিবারের সদস্যদের বুকে জড়িয়ে ধরেন শেখ হাসিনা। সেই সময় এক আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হয়। সেগুনবাগিচা বলছে, নির্বাচনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরটি ‘সার্বজনীন’ রূপ পেয়েছে।
সফরের প্রথমদিনে বিজেপি’র প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির সঙ্গে কুশলবিনিময় হয়েছে তার। নব্বইঊর্ধ্ব ওই নেতা এখন রাজনীতি ছেড়ে অবসর জীবন-যাপন করছেন। শেখ হাসিনা তার স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নেন। রোববার প্রধানমন্ত্রী তার সফরের মূখ্য উপলক্ষ নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যথাসময়ে উপস্থিত হন।
ভারতের ‘প্রথম সম্মানীয়’ অতিথি হিসেবে যাওয়া শেখ হাসিনাকে যথাযথ মর্যাদায় অনুষ্ঠানে অভ্যর্থনা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান অংশ নিলেও স্পটলাইট ছিল শেখ হাসিনার ওপর। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতোই লঙ্কান প্রেসিডেন্টের বাড়তি খাতির পাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে। বিশ্লেষকরা বলছেন- সরকার এবং বিরোধী দল উভয়ের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে নির্বাচনোত্তর ভারতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একধরনের ‘ব্যালেন্স’- রক্ষার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের ভারসাম্যের ওই কূটনীতি কতটা সফলতা পেয়েছে বা পাবে তা হয়তো সময়ই বলে দেবে।
এদিকে রোববার সন্ধ্যায় নতুন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তারা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আগামীতে সুদৃঢ় করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, দুই নেতাই আশা প্রকাশ করেছেন, বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আগামী দিনগুলোতে আরও গভীর করার বিষয়ে। ড. মাহমুদ বলেন, অত্যন্ত উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে রাষ্ট্রপতি ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার ভারতীয় সমকক্ষকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, পরে দুই প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু আয়োজিত ভোজসভায় যোগ দেন। হাছান মাহমুদ বলেন, ভারতের সিনিয়র মন্ত্রীগণ, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল, আমন্ত্রিত সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা নৈশভোজে অংশ নেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাদের মধ্যে কুশলবিনিময় হয়। নরেন্দ্র মোদি গত ১০ বছর ধরে তার রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন এবং শেখ হাসিনাও ইতিমধ্যে ১৫ বছর ধরে তার সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন এবং একে-অপরের কাছ থেকে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহুমুখী সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে অনেক বিষয় জড়িত। যেহেতু উভয় সরকার দেশ পরিচালনায় অব্যাহত রয়েছেন, সেহেতু একসঙ্গে কাজ করার কিছু সুবিধা আছে।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, উভয় দেশের জনগণ বিভিন্ন দিক থেকে উপকৃত হচ্ছে যার মধ্যে দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে যোগাযোগ রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, ‘আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও সমপ্রসারিত এবং আরও গভীর হবে।’ ব্রিফিংয়ে অন্যান্যের মধ্যে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।
‘প্রাণের মাঝে আয়’-মোদির শপথ শেষেই সোনিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন হাসিনা: ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম সংবাদ প্রতিদিনের রিপোর্টে বলা হয়, রোববার রাষ্ট্রপতি ভবনে মোদির শপথ অনুষ্ঠান সেরে সোমবার পুরনো ‘বান্ধবী’ সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় শেখ হাসিনার। দীর্ঘদিন পর এই মুখোমুখি সাক্ষাতে তারা একে-অপরকে জড়িয়ে ধরেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস চেয়ারপার্সনের এই মৈত্রীর ছবি ইতিমধ্যেই ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায়। দিল্লির আইটিসি মৌর্য হোটেলে ছিলেন শেখ হাসিনা। সোমবার দুপুরে সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কংগ্রেস হাইকমান্ড সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াংকা গান্ধী। তিনজনের সঙ্গেই কুশলবিনিময় করেন শেখ হাসিনা। সূত্রের খবর, দীর্ঘক্ষণ খোশমেজাজে গল্পও করেন তারা। গান্ধী পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় সে কথা প্রকাশ্যে আনেন কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী। তিনি জানান, দুপুরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। সঙ্গে ছিলেন কংগ্রেস চেয়ারপার্সন সোনিয়া গান্ধী ও কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি প্রিয়াংকা গান্ধী। বিশ্বাস, সহযোগিতা এবং পারস্পরিক উন্নতির প্রতিশ্রুতির উপর ভিত্তি করে ভারত ও বাংলাদেশের গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সেই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে আমাদের মধ্যে।
উল্লেখ্য, কংগ্রেস ক্ষমতায় না থাকলেও গান্ধী পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক শেখ হাসিনার। সোনিয়ার শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে স্বাধীন করতে বাংলাদেশকে সর্বোতভাবে সহায়তা করেছিলেন। সেই রিপোর্ট মতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তার কন্যা শেখ হাসিনা ও তার এক বোনের নিরাপত্তার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিল ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার। সেই সুবাদেই গান্ধী পরিবারের সঙ্গে হাসিনার সম্পর্ক আত্মীয়ের মতো। এবং তা আজও অটুট।
ফলে যতবারই তিনি ভারতে এসেছেন চেষ্টা করেছেন গান্ধী পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের। এবার দিল্লি গিয়েও সে সুযোগ হাতছাড়া করেননি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনার সঙ্গে সোনিয়া পরিবারের সাক্ষাৎ নিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে বহু রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। সব রিপোর্টেই ঘুরে-ফিরে কংগ্রেসের সঙ্গে শেখ হাসিনার বরাবরই ভালো সম্পর্ক থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। আগেও দিল্লিতে গান্ধী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেখ হাসিনার দেখা হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ‘নিউজ-১৮’ এর খবরের শিরোনাম ছিল এমন ‘সোনিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন হাসিনা, রাহুল-প্রিয়াংকাকেও আদর, কংগ্রেসের অভ্যর্থনায় মুগ্ধ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’।
আপনার মতামত জানানঃ