গত কয়েক দশক ধরে জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর বস্তুতন্ত্র তথা সমগ্র প্রাণীকুল মহা-সঙ্কটে পড়েছে। এখন প্রত্যেক বছরই দাবদাহ, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও উপকূলীয় এলাকায় বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করছে বিশ্ব৷ মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের ফলে পরিবেশে যে বাড়তি তাপ তৈরি হচ্ছে, এর ফলে দক্ষিণমেরুর বরফ গলছে দ্রুতহারে, সাগর-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্বের প্রাণীজগতের ওপর। জলবায়ুর বিরূপ এই পরিবর্তনের জন্য বায়ুমণ্ডলে অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণের কারণকে দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রাকৃতিকভাবে জলবায়ুর যে স্বাভাবিক পরিবর্তন হওয়ার কথা এবং যে পরিবর্তন ও বিবর্তনে আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জলবায়ুর সে পরিবর্তন ছাপিয়ে মনুষ্যসৃষ্ট কারণে জলবায়ু ও বস্তুতন্ত্র ইতোমধ্যেই অনেকখানি পরিবর্তিত হয়েছে। পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই পরিবর্তনের পেছনে কাজ করেছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সমুদ্র ও মহাসমুদ্রের অম্লতা বৃদ্ধি ও তাদের গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন, মেরু অঞ্চলের বড় বড় বরফের আস্তরণের অবস্থান ও আকারের পরিবর্তন এবং অতিমাত্রার জলবায়ুগত বিভিন্ন ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে৷ বিশ্লেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই সামান্য। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ৷ জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা জানিয়েছে যে, এই শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে৷ দেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ওই ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে৷ এ কারণে ঘর হারাবে প্রায় দুই কোটি মানুষ৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বন্যার ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগও বেশি হচ্ছে। এর মধ্যে আছে, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, তীব্র দাবদাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে বছরের প্রায় দশ মাস গরম থাকা। বছরে কোনো রকমে দুই মাস তাপমাত্রা একটু কম থাকে, যার মধ্যে এক মাসকে আমরা এখন শীতকাল বলে ধরে নিই৷ সেটি সাধারণত নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়৷ এই বছর সারাদেশ শীতের দেখা পায়নি বললেই চলে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কৃষি ক্ষেত্রে। প্রত্যেক বছরই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যায় হাজার-হাজার বর্গকিলোমিটার কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশের দরিদ্র মানুষ তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বেঁচে থাকার জন্য তাদের নানা রকম প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ব নেতারা দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারলে আগামীতে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে বিশ্বকে৷ আর কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ এক কথায় আমাদের ‘ব্লু-প্ল্যানেট’ এখন মহা-সঙ্কটে এবং এর জন্য আমারাই দায়ী। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এর জন্য রাজনৈতিকদের ওপর জনগণের চাপ বাড়ানো খুবই জরুরি।
পরিশেষে একটি ইতিবাচক ঘটনা দিয়ে শেষ করা যাক। সাম্প্রতিককালে দেশীয় গণমাধ্যমে এক বিচিত্র তথ্য উঠে এসেছে। গত দুই বছর ধরে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১৭৪টি ইট ভাটা বন্ধ করেছে প্রশাসন। একসময় এসব ইট ভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হতো এলাকাবাসীর। আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গাছপালায় কোনো ফসল হত না। সাধারণ মানুষ শ্বাসকষ্টসহ নানা প্রকার চর্মরোগে ভুগছিল। বিলে পাওয়া যেত না মাছ। মোট কথা জীববৈচিত্র প্রায় হারাতে বসেছিল। এ সকল ইট ভাটা বন্ধ করায় সেখানে সরিষা, ধান ও বিভিন্ন শাক-সবজি চাষ করছেন জমি মালিকরা। এতে ওইসব এলাকায় প্রায় ২০-২৫ বছর আগের পরিবেশ ফিরে এসেছে। কৃষকের ঘরে উঠছে নতুন ধান, নানা প্রকার শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসল। সবুজে ভরে গেছে পুরো এলাকা। ইটভাটার কালো ধোয়া ও ধুলাবালি থেকে দূষণমুক্ত হয়েছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন। এটি হয়তো দূষণ মুক্ত পরিবেশ গড়ার একটি ক্ষুদ্র প্রায়শ মাত্র। তবে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগামীর বিশ্ব পুনোরায় হতে পারে দূষণমুক্ত সবুজ পৃথিবী।
আপনার মতামত জানানঃ