বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যয়ে বড় অংশের জোগান দেয় বিদেশী ঋণ সহায়তা। এ ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে সরকারের ব্যয় এখন ক্রমেই বাড়ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের অর্থ ছাড় করেছে ৫৬৩ কোটি ডলার। এ সময় সরকারকে বিদেশী ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছে ২৫৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। সে হিসেবে অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণ হিসেবে ছাড়কৃত অর্থের অর্ধেকের কাছাকাছি (প্রায় ৪৬ শতাংশ) ব্যয় হয়েছে ঋণের কিস্তি (সুদ ও আসল) পরিশোধে।
সামনের দিনগুলোয় বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। এমনকি তখন ঋণের অর্থছাড় এবং এর বিপরীতে সুদ-আসল পরিশোধ কাছাকাছি পর্যায়েও চলে আসতে পারে।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে একই সময়ে (জুলাই-মার্চ) দেশে বিদেশী ঋণের অর্থছাড় হয় ৫৩৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর ওই সময়ে ঋণ পরিশোধে (আসল ও সুদ) ব্যয় হয় ১৭৩ কোটি ৩ লাখ ডলার, যা ছাড়কৃত অর্থের ৩২ দশমিক ২৬ শতাংশ।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩-এর প্রথম তিন প্রান্তিকে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় যে গতিতে বেড়েছে, ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে পরিশোধকৃত অর্থের মধ্যে সুদের পরিমাণ ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময় মোট সুদ পরিশোধ হয়েছিল ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আসল বা মূল ঋণের অর্থ হিসেবে পরিশোধ হয়েছে ১৫১ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের বেশি অর্থ, যা গত অর্থবছরের একই সময় ছিল প্রায় ১২৪ কোটি ৪৫ লাখ ডলার।
দেশে রেমিট্যান্স ও রফতানিসহ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে আমদানি দায় ও ঋণ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে বেশি। ফলে নিম্নমুখিতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়নে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ এখন ২৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন। যদিও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বা বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে, দেশে রিজার্ভ এখন ১৯ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।
বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন প্রকল্পে নেয়া ঋণের অর্থ পরিশোধের চাপ গত কয়েক বছরে ক্রমাগত বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী ট্যানেলের মতো মেগা প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিশোধ শুরু হলে এ চাপ আরো অনেক জোরালো হয়ে উঠবে।
এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণ নেয়া হয়েছে বেশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এর মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় ঋণটি নেয়া হয়েছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে। এ প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ১ হাজার ১৩৮ কোটি (১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন) ডলার ঋণ অর্থায়নের চুক্তি রয়েছে। এ ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা ২০২৭ সালের মার্চ থেকে। যদিও গত মার্চে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকের পর ইআরডি ঋণের কিস্তি দুই বছর পিছিয়ে ২০২৯ সালের মার্চে নেয়ার জন্য রাশিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে।
বিদেশী ঋণ পরিশোধে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার জোগান পেতে আইএমএফের ঋণ গ্রহণ করেছে। ৪৭৩ কোটি ডলারের এ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি এরই মধ্যে পেয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় কিস্তির অর্থছাড় করতে সদ্য আইএমএফ মিশনের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে গেছে।
সংস্থাটি ঋণ দিতে বাংলাদেশকে নানা খাতে সংস্কারের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। এ সংস্কারের অংশ হিসেবে দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়া, খেলাপি ঋণ ব্যাংকে ফেরানো, ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুসহ সরকারকে রাজস্ব আদায়ে আরো কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে বড় কয়েকটি প্রকল্পের ঋণের ম্যাচুরিটি পিরিয়ড শুরু হচ্ছে। এগুলোর সুদ-আসল পরিশোধ শুরু হয়েছে। এটি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আগামীতে আরো বাড়বে। একদিকে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে সুদ-আসল পরিশোধ বাড়ছে। এ রকমটা না থাকলে হয়তো আজকে আমাদের অর্থনীতিতে ভিন্ন চিত্র দেখা যেত।’
তিনি আরো বলেন, ‘যে ঋণে আমরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি, সেগুলো আমাদের সেবা বিক্রি করে, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিক্রি করে এমনকি মহাসড়কের টোল আদায় করে পরিশোধ করা হচ্ছে। এখানে খরচ বাড়ার পেছনে মুদ্রার বিনিময় হার বেড়ে যাওয়াটাও অন্যতম কারণ। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সুশাসন প্রয়োজন। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায় এমন সাশ্রয়ী প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে, যেন আগামীতে আরো বড় ঋণের চাপে না পড়ি। পাশাপাশি রেমিট্যান্স ও রফতানির মাধ্যমে রিজার্ভও বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।’
দেশের উন্নয়ন অবকাঠামোর বড় অংশই বাস্তবায়ন হচ্ছে বৈদেশিক সহায়তায়। এসব সহায়তা পাওয়া সাপেক্ষে বাস্তবায়ন হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্প। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থ ব্যয় করতে না পারায় কাটছাঁটের পর এডিপির আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায়।
এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্য ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক ঋণও কমে দাঁড়ায় ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপি তথা উন্নয়ন বাজেটে বৈদেশিক ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ কোটি টাকা ধরা হয়েছে, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
দেশে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় না হওয়ার পেছনে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিকে দায়ী করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্যে, বিদেশী প্রতিশ্রুত ঋণের বড় অংশই আসে প্রকল্প ঘিরে। ফলে সেখানে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।
সাবেক অর্থ সচিব এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতায় ঘাটতি থাকার কারণে পাইপলাইনে থাকা সত্ত্বেও বিদেশী সহায়তার অর্থ দেশে আসছে না। প্রকল্প বাস্তবায়ন বাড়াতে পারলে প্রতিশ্রুত সহায়তার অর্থ আরো বেশি ছাড় করা সম্ভব হতো। এতে অর্থছাড়ের তুলনায় ঋণ পরিশোধের পরিমাণ কমে আসত। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা বাড়াতে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।’
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি এসেছে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং জাপানের কাছ থেকে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২৬২ কোটি ডলারের। ছাড় করেছে ১৪০ কোটি ২৭ লাখ ডলার। এডিবি ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ১৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের। ছাড় করেছে ৯৬ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। জাপানের প্রতিশ্রুত ও ছাড়কৃত অর্থের পরিমাণ যথাক্রমে ২০৩ কোটি ৫৯ লাখ ও ১৩৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। চীনের কাছ থেকে এ সময় কোনো ঋণ প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এমএ মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করে গতকাল তাৎক্ষণিকভাবে তার মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে তিনি বণিক বার্তাকে বলেছিলেন, ‘আমরা আশা করি, সামনে শুধু ঋণ নয়; আয়ও বাড়বে। অর্থনীতি আরো প্রসারিত হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
আয়ের পরিমাণও বাড়বে। আমরা অবকাঠামো খাতে অনেক বিনিয়োগ করেছি এবং সেখান থেকে অনেক রিটার্ন আসবে বলে প্রত্যাশা করি, কিছু আসছেও। তবে একটি বিষয় হলো আমরা ঋণ করছি ডলারে, কিন্তু আয় করছি টাকায়। এখন আমাদের ডলারে আয় বাড়াতে হবে। তার মানে হচ্ছে রফতানির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে আয় আরো বাড়াতে হবে। পাশাপাশি রেমিট্যান্সের পরিমাণও আরো বাড়াতে হবে।’
আপনার মতামত জানানঃ