রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবিএল) ভারত থেকে টাওয়ারের জন্য ৬৮ কিলোগ্রাম বল্টু, নাট ও ওয়াশার আমদানি করেছে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৯৫ ডলার দিয়ে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। চুক্তি মূল্যের চেয়ে এসব সরঞ্জামের দাম ১ হাজার ৬১৯ গুণ বেশি ধরা হয়েছে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে পিজিসিবিএল যে ক্রয় চুক্তি জমা দিয়েছে সে অনুসারে, প্রতি কেজি ২ দশমিক ১৮ ডলার দরে এই চালানের প্রকৃত মূল্য হওয়ার কথা ১৪৮ ডলার। গত বছরের এপ্রিলে চালানটি মোংলা বন্দরে পৌঁছালেও অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যের কারণে এগুলো খালাস করতে দেয়নি শুল্ক কর্মকর্তারা।
পিজিসিবিএলের অধীনে ইস্টার্ন গ্রিড নেটওয়ার্ক প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান টিবিইএ কো. লিমিটেড ভারতের স্কিপার লিমিটেড থেকে এসব মালামাল আমদানি করেছে। এগুলো ব্যবহার করা হবে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ফেনী অঞ্চলে বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন এবং টাওয়ার নির্মাণের জন্য।
শুল্ক নথি এবং ক্রয় চুক্তির তথ্য অনুযায়ী, এর আগে একই পণ্যের ১৭৮ দশমিক ৮ টন আমদানি করতে পিজিসিবিএল খরচ করেছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ২৫২ ডলার। অর্থাৎ, প্রতি কেজি ২ দশমিক ১৮ ডলার দরে।
গত বছরের ৫ জুনে মোংলা কাস্টমস হাউস কমিশনারের কাছে অস্বাভাবিক মূল্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পিজিসিবিএল এক চিঠিতে লিখেছে, এবার আমদানির পরিমাণ কম হলেও দাম বেশি। কারণ আগের চালানে ভুলবশত বেশি পণ্য পাঠানো হয়েছিল।তারা আরও বলেছে যে, গড় আমদানি মূল্য ক্রয় চুক্তির সীমার মধ্যেই রয়েছে।
মোংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনার এ কে এম মাহবুবুর রহমান দ্য গণমাধ্যমকে জানান, পিজিসিবিএল মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে সন্তোষজনক উত্তর দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং আগের দুটি চালানের এলসি ও ইনভয়েসের মতো প্রাসঙ্গিক নথি জমা না দেওয়ায় চালানটি আটক রাখা হয়েছে।
শুল্ক কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও মালামালগুলো ছাড়াতে না পেরে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি এখন নথিতে ‘মানবিক ত্রুটি’র অজুহাতে পণ্যগুলো পুনরায় রপ্তানি করতে চাইছে।
মাহবুবুর রহমান জানান, তারা এ বিষয়ে এনবিআরের মতামত চেয়েছেন এবং নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটির উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছেন।
নথি অনুযায়ী, পিজিসিবিএল ১৭৮ দশমিক ৮৭ টন টাওয়ার বল্টু, নাট ও ওয়াশার সরবরাহের জন্য ২০২২ সালের ২৩ জুন চীনা কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তি করে। পরবর্তীতে ভারতীয় সরবরাহকারী ও চীনা আমদানিকারক এসব পণ্যের জন্য প্রতি কেজি ২ দশমিক ১৭৬ ডলার মূল্য নির্ধারণ করে।
ভারতীয় সরবরাহকারী স্কিপার লিমিটেডের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ইমেইল করা হলেও তারা কোনো জবাব দেয়নি। গতকাল সোমবার চীনা কোম্পানিটির ঢাকা অফিসে গেলে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদককে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির ফ্রন্ট ডেস্কের একজন কর্মী বলেছেন, এ বিষয়ে তাদের কোনো মন্তব্য নেই।
দায়মুক্তির চেষ্টা
মোংলা কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, চালানটি ছাড়াতে না পেরে গত ১০ মার্চ পিজিসিবিএল পণ্যগুলো পুনরায় রপ্তানির জন্য আবেদন করে।
প্রকল্প পরিচালক ও পিজিসিবিএলের প্রধান প্রকৌশলী মো. শাহাদাত হোসেনের সই করা আবেদনে বলা হয়েছে, এই চালানের জন্য ঠিকাদার টিবিইএ কোম্পানি লিমিটেডকে কোনো অর্থ প্রদান করা হয়নি। আবেদনে আরও বলা হয়েছে, পণ্যগুলো ‘ভুলবশত’ আমদানি করা হয়েছিল।
তবে কাস্টমসের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার চেষ্টা করে আসছে। এমনকি প্রকল্প পরিচালক পণ্য খালাসের জন্য একজন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টও নিয়োগ করেছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, ‘সব প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়েছে তখন তারা দাবি করেছে যে, পণ্যগুলো ভুলবশত আমদানি করা হয়েছিল। তাদের এই দাবি অত্যন্ত হাস্যকর।’
কাস্টমসের নথিও তাই বলছে।
নথিগুলোতে দেখা যায়, পিজিসিবিএল পণ্যগুলো খালাসের জন্য এসআই চৌধুরী অ্যান্ড কো নামে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নিয়োগ করেছে, এমনকি চীনা কোম্পানিকে আমদানির জন্য নিজস্ব বিআইএন নম্বর ব্যবহার করারও অনুমতি দিয়েছে।
মোংলা কাস্টমস কমিশনার এ কে এম মাহবুবুর রহমান গত ১৬ এপ্রিল এনবিআরকে মতামত চেয়ে চিঠি দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, এটাকে ভুল বলে দাবি করা হলেও তাদের কার্যক্রম তা বলছে না।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আমদানিকারক বলছে যে চালানটি অসতর্কভাবে ভুল গন্তব্যে পাঠানো হয়েছিল, এটা অসত্য।’
এতে আরও বলা হয়, ‘সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অস্বাভাবিক দাম লক্ষ্য করলে পিজিসিবিএলের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর ব্যাখ্যা সন্তোষজনক ছিল না। তারা শুধু বিক্রয় চুক্তি ও প্রফর্মা চালান জমা দিয়েছে। যদিও বিক্রয় চুক্তিতে বলা হয়েছে যে, আমদানি ব্যয়ের ৮০ শতাংশ এলসির মাধ্যমে রপ্তানিকারককে দিতে হবে, আমদানিকারক এলসির কোনো অনুলিপি জমা দেয়নি।’
প্রকল্প পরিচালক শাহাদাত দ্য গণমাধ্যমকে জানান, পণ্য কেনার জন্য চীনা কোম্পানি টিবিইএর সঙ্গে তাদের চুক্তি রয়েছে। কীভাবে এবং কত দামে ভারতীয় সংস্থা থেকে পণ্য আমদানি করবে, তা ওই কোম্পানির ওপর নির্ভর করে।
তিনি বলেন, ‘আমরা চীনা কোম্পানিকে পণ্য আমদানির জন্য আমাদের বিআইএন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি, কারণ আমরা ওই পণ্যের গ্রাহক।’
এই পণ্যের দাম এত বেশি ধরার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং পিজিসিবিএলের নির্বাহী প্রকৌশলী ফখরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
ফখরুল ইসলাম জানান, ভারতীয় কোম্পানির অসাবধানতার কারণেই এগুলোর এত উচ্চমূল্য দেখানো হয়েছে।
তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা পরে এটা দেখেছি। দেখার পর চালানটি ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছি।’
এনবিআরের প্রথম সচিব মো. মাহবুবুর রহমান গত ২৩ এপ্রিল গণমাধ্যমকে জানান, তিনি মোংলা কাস্টমস কমিশনারের চিঠি পেয়েছেন।
তিনি জানান, যেকোনো পুনঃরপ্তানির জন্য প্রথমে তাদের যাচাই করতে হয় যে, চালানের জন্য ব্যাংকিং বা নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থপ্রদান করা হয়েছে কিনা।
মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমদানিকারক আমদানি করার অনুমতি পেয়েছেন কিনা, সেটাও আমাদের যাচাই করতে হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত এসব তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারি ততক্ষণ পর্যন্ত সেগুলো পুনরায় রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হবে কিনা, সেটা আমরা নির্ধারণ করতে পারি না।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের মতে, এ ধরনের দুর্নীতি করা হয় অর্থপাচারের জন্য।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ব্যাংকে এলসি খোলার চেয়ে প্রকল্পের ঠিকাদারদের মাধ্যমে অর্থপাচার করা সহজ। সেখানে নূন্যতম জবাবদিহি নেই এবং ধরা পরলেও কাউকে তেমন একটা দায়ী করা হয় না।’
তিনি বলেন, ‘শাসক শ্রেণী নিজেরাই দুর্নীতিতে জড়িত বলেই প্রকল্পের কর্মকর্তারা টাওয়ার নাট-বল্টুও এমন অতিরিক্ত দামে কেনার সাহস করেন।’
আপনার মতামত জানানঃ