অবৈধ জুয়া, ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর এসব অপরাধে জড়িত সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের শেষদিকে র্যাবের সাথে মাঠে নামে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। এ পর্যন্ত মামলা দায়ের থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন ব্যক্তির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সংস্থাটি। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে নেওয়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। যুবলীগ নেতা (বহিষ্কৃত) ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কাজী আনিসুর রহমানের ১৪ কোটি ৯৫ লাখ ২৯ হাজার ৮৩৬ টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া তার স্ত্রী সুমি রহমানের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য মিলেছে। তদন্তকালে কাজী আনিছের বিরুদ্ধে ২৫টি ব্যাংক হিসাবে ১২৯ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় সাবেক যুবলীগ নেতা কাজী আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী সুমী রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) অনুমোদন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বৃহস্পতিবার(১৪জানু) কমিশনের এক সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেন, ‘শিগগিরই’ এই অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হবে। মামলার তদন্তে আনিসুর রহমানের নামে ১৪ কোটি ৯৫ লাখ ২৯ হাজার ৮৩৬ টাকা ও সুমী রহমানের ২ কোটি ৬১ লাখ ৬২ হাজার ২১৮ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে র্যাবের অভিযানে ঢাকার বিভিন্ন স্পোর্টিং ক্লাবে ক্যাসিনো কারবারে যুবলীগ নেতাদের সম্পৃক্ততার তথ্য বেরিয়ে আসে। ক্যাসিনোকাণ্ডসহ নানা অনিয়মে সংগঠনটির সামনের সারির কয়েক নেতা গ্রেপ্তার হন। সে সময় কয়েক বছরের মধ্যে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার তথ্য গণমাধ্যমে এলে আত্মগোপন করেন কাজী আনিস। পরে ১১ অক্টোবর তাকে বহিষ্কার করে যুবলীগ। একই বছরের ২৯ অক্টোবর কাজী আনিস ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আলাদা মামলা করে দুদক। আনিসের বিরুদ্ধে মামলায় ক্যাসিনো কারবারের মাধ্যমে ঘোষিত আয়ের বাইরে ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকার সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ আনা হয়। মামলাটির তদন্ত করেন দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। তিনি দীর্ঘ তদন্ত শেষে চার্জশিট দাখিলের জন্য কমিশনে গতকাল বৃহস্পতিবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাজী আনিসুর রহমানের নামে ১৮ কোটি ৮৯ লাখ ১ হাজার ৩৩৫ টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মাত্র ৩ কোটি ৯৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৯ টাকা মূল্যের সম্পদই বৈধ। বাকি ১৪ কোটি ৯৫ লাখ ২৯ হাজার ৮৩৬ টাকার সম্পদের বৈধ কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। এছাড়া তার নিজ ও প্রতিষ্ঠানের নামে ২৫টি ব্যাংক হিসাবে ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১২৯ কোটি ৯১ লাখ ১৭ হাজার ২১৩ টাকা জমা করেন। যার মধ্যে শেয়ার ব্যবসাসহ অন্যান্য খাত থেকে আয় হয়েছে ৬ কোটি ৩৬ লাখ ৭১ হাজার ৩৬৫ টাকা। অর্থাৎ ১২৯ কোটি ৯১ লাখ ১৭ হাজার ২১৩ টাকার মধ্যে ১২৩ কোটি ৫৪ লাখ ৪৫ হাজার ৮৪৮ টাকা টাকা সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে, যা অপরাধলব্ধ আয়ের উৎস গোপন বা আড়াল করার অসৎ উদ্দেশ্যে তা স্থানান্তর, হস্থান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে অবস্থান গোপন করে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এসব বিষয় তুলে ধরে চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান কমিশনে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
কমিশন তদন্ত কর্মকর্তার সুপারিশের আলোকে আসামি কাজী আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দেয়।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাজী আনিসুর রহমানের স্ত্রী মোছা. সুমি রহমানের নামে ২ কোটি ৬৩ লাখ ৬২ হাজার ২১৮ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে। এ সম্পদের মধ্যে বৈধ আয় পাওয়া গেছে মাত্র ২ লাখ টাকার। বাকি ২ কোটি ৬১ লাখ ৬২ হাজার ২১৮ টাকা মূল্যের সম্পদের কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। তার স্বামী কাজী আনিসুর রহমান অবৈধ অর্থ বিভিন্ন উপায়ে স্ত্রীর হিসাবে স্থানান্তর করে স্ত্রীকে অবৈধ সম্পদ অর্জনে সহায়তা করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এসব অপরাধের দায়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার সুপারিশের ভিত্তিতে আসামি মোছা. সুমি রহমান ও তার স্বামী কাজী আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় কমিশন একটি চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার এমন নজির রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে। সুতো ধরে টান দিলে এমন রাঘব বোয়াল দলে দলে বেরিয়ে আসবে। তাদের অধিকাংশই অবশ্য অর্থ কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এসব ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন। এমনকি কার কাছে কেমন অবৈধ সম্পদ রয়েছে এসব বিষয়ে প্রশাসন ওয়াকিবহাল থাকলেও উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ইশারা পাচ্ছেন না বলে ব্যবস্থাও নিচ্ছেন না। সরকার ২০১৯ সালের শেষদিকে শুদ্ধি অভিযান চালালেও এখন আদতে থেমে গেছেন। তারমানে এই নয় দেশে অবৈধ সম্পদধারী কেউ নেই। সরকার নিজেদের স্বার্থ বুঝে এসব অভিযান পরিচালনা করেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অবৈধ সম্পদধারী সকলকে আইনের আওতায় এনে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তারা। একইসাথে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শুদ্ধি অভিযান পুনরায় চালু করার আহ্বান জানান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ