আলবার্ট আইনস্টাইন তার স্ত্রী মিলেভাকে একটি নোট পাঠিয়েছিলেন। নোটে তারা যাতে একসাথে থাকতে পারে তার জন্য মিলেভাকে কী করতে হবে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। নোটে আইনস্টাইন মিলেভাকে তার জামাকাপড় ধোয়া, দিনে তিনবার খাবার তৈরি করা, শোবার ঘর পরিষ্কার করা এবং তার অফিস (যা শুধু তিনি ব্যবহার করবেন) পরিপাটি রাখার কথা বলেছিলেন।
ক্রোট ঔপন্যাসিক স্লাভেনকা ড্রাকুলিচ তার উপন্যাস “মিলেভা আইনস্টাইন: থিওরি অব স্যাডনেস”-এ এক ভয়ানক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন যা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রথম স্ত্রী মিলেভা আইনস্টাইনের জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি আইনস্টাইনের তত্ত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।
১৯১৪ সালের জুলাই মাসে আলবার্ট আইনস্টাইন তার স্ত্রী মিলেভাকে একজন পারস্পরিক বন্ধুর মাধ্যমে একটি নোট পাঠিয়েছিলেন। নোটে তারা যাতে একসাথে থাকতে পারে তার জন্য মিলেভাকে কী করতে হবে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। নোটে আইনস্টাইন মিলেভাকে তার জামাকাপড় ধোয়া, দিনে তিনবার খাবার তৈরি করা, শোবার ঘর পরিষ্কার করা এবং তার অফিস (যা শুধু তিনি ব্যবহার করবেন) পরিপাটি রাখার কথা বলেছিলেন।
নোটে আইনস্টাইন বলেছিলেন, “আপনি আমার সাথে যে কোন সম্পর্ক থেকে বিরত থাকবে, যদি না এটি সামাজিক কারণে প্রয়োজন হয়।”
তিনি মিলেভাকে বাড়িতে তার সাথে সময় কাটাতে এবং একসাথে ভ্রমণ করা ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছিলেন। তাদের মধ্যে কোন ঘনিষ্ঠতা থাকবে না, শুধু ন্যূনতম যোগাযোগ ছাড়া। তাদের সন্তানদের আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে নেওয়া যাবে না। এগুলো আলবার্ট আইনস্টাইনের শর্ত ছিল যা তিনি মিলেভাকে মেনে নিতে বলেছিলেন।
তারা তখন বার্লিনে বসতি স্থাপন করেছিলেন যদিও সেই সময়ে তারা আলাদাভাবে বসবাস করতেন। আইনস্টাইনকে প্রুশিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেসের সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এবং কায়জার উইলহেলম ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্সের পরিচালক হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে তাঁর গবেষণা চালানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় এবং স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু মিলেভা গুজব শুনেছিলেন, অ্যালবার্ট তার চাচাতো বোন এলসা লোভেন্থালের (তারা ১৯১৯ সালে বিয়ে করেন) প্রেমে পড়েছিলেন এবং তার সাথে তিনি নিজের মায়ের বাড়িতে সময় কাটিয়েছিলেন। মিলেভা এবং তার বাচ্চারা তখন বন্ধুদের সাথে থাকতেন।
এই শর্তগুলো স্লাভেনকা ড্রাকুলিচ ইতালিয়ান ভাষায় পুনরায় লিখেছেন। সেগুলো তিনি কয়েকটি আসল নথির মধ্যে পেয়েছিলেন। এগুলো তিনি তার উপন্যাসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। সাদামাটা এই চিঠিকে শুধু একটি সামান্য কাগজের টুকরো মনে হলেও এটি মিলেভার সংসার, তার সংগ্রাম ও তার জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে।
স্লাভেনকা ড্রাকুলিচ শুরুতে নিশ্চিত ছিলেন, মিলেভা আত্মসমর্পণ করবেন এবং তিনি সেই অপমানজনক শর্তগুলোতো স্বাক্ষর করবেন যা তাকে ‘মহান ব্যক্তির’ পরিচারিকা করে তুলবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিলেভা তা করেননি, তিনি মাথা তুলে আলবার্টের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এবং অল্প সময়ের মধ্যে তিনি তাকে (আলবার্ট আইনস্টাইন) বিভিন্ন শর্ত মেনে নিতে বাধ্য করেন যেখানে অ্যালবার্ট তার সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং শিক্ষার জন্য কিছু অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মিলেভা তারপর তাদেরকে সাথে করে জুরিখে চলে যায়।
অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার একদিন পরে তারা সেখানে পৌঁছান। বেলগ্রেডে তখন মাত্র বোমা হামলা করা হয়েছিল। ৭৪ বছর বয়সী স্লাভেনকা ড্রাকুলিচ পুরানো ইউরোপের পতন এবং এ বিপর্যয়ের মধ্যে একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে মধ্যে যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল তা সমান্তরালে দেখানোর চেষ্টা করেছেন তার উপন্যাসে। ঠিক তার কিছু বছর আগেই তারা গণিত এবং পদার্থবিদ্যার জন্য নিজেদের আবেগ ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন যা থেকে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়েছিল।
মিলেভা একটি ধনী সার্বিয়ান পরিবারের সদস্য ছিলেন যারা অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সীমান্তের নোভি সাদে বসবাস করতেন। তারা ছিলেন ‘অর্থোডক্স খ্রিষ্টান’। তার বাবা তাকে পড়াশোনার জন্য তাগাদা দিয়েছিলেন যা সেই সময়ের নারীদের জন্য একটি বিরল ঘটনা ছিল। তিনি একটু খুড়িয়ে হাঁটতেন অর্থাৎ ছোটবেলায় তার খুব কঠিন সময় কেটেছিল।
কিন্তু নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তিনি এই প্রতিবন্ধকতা জয় করেছিলেন। জুরিখে তিনি একটি ইহুদি পরিবারের একজন বিভ্রান্ত, অপরিণত এবং মেধাবী ছেলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন (যদিও তিনি তার বিশ্বাস রাখেননি)। আলবার্ট আইনস্টাইন তার চেয়ে চার বছরের ছোট ছিলেন। কিন্তু তারা একে অন্যকে পুরোপুরি বুঝতেন। তারা প্রেমে পড়েছিলেন এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জল্পনা-কল্পনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। মিলেভা অ্যালবার্টের তত্ত্বের গাণিতিক অংশে কাজ করেছিলেন, বিশেষ জার্নালগুলোর জন্য পর্যালোচনা লিখেছিলেন (যেটিতে তিনি তার নাম রেখেছিলেন)। এমনকি যখন তিনি (অ্যালবার্ট) শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছিলেন তখন মিলেভা তার ক্লাসের জন্য নোট প্রস্তুত করে দিতেন।
১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক কাজে মিলেভা মারিকের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা বিভিন্ন বই এবং সিনেমাতে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু ক্রোট ঔপন্যাসিক স্লাভেনকা ড্রাকুলিচ এই নিয়ে দীর্ঘ কাজ করেছেন। তার অন্যান্য কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ‘দ্য টেস্ট অব এ ম্যান (১৯৯৭) এবং ‘হাউ উই সারভাইভড কমিউনিজম অ্যান্ড ইভেন লাফড’ (১৯৯১)। স্লাভেনকা তার উপন্যাসে মিলেভার সমগ্র অস্তিত্বকে নতুন করে সাজিয়েছেন। স্লাভেনকার মতে, মিলেভা জীবন থেকে এমন সব আঘাত পেয়েছিলেন যে তিনি তার অভিজ্ঞতাগুলোকে একটি ‘থিওরি অব স্যাডনেস’ (দুঃখের তত্ত্ব) হিসেবে রূপান্তর করতে পেরেছিলেন।
একদিন যখন তারা মেরি কিউরির (নোবেল বিজয়ী রসায়নবিদ) সাথে ভ্রমণে বেড়িয়েছিলেন তখন অ্যালবার্ট মেরির বাচ্চাদের আয়ার সাথে ফ্ল্যার্ট করা শুরু করেছিলেন। হঠাৎ “মিলেভার কাছে মনে হয়েছিল যে সে এমন কিছু হয়ে গেছে যার দিকে কেউ তাকায় না, একটা পুরাতন আর্মচেয়ারের মতো।” স্লাভেনকা ড্রাকুলিচ তার উপন্যাসে এই গল্পগুলোই বলেছেন।
মিলেভা অ্যালবার্টের মতো একই সময়ে পদার্থবিদ্যা এবং গণিতে তার ডিগ্রি অর্জন করতে পারেনি কারণ তাকে ভয়ানক মানসিক অবস্থার মধ্যে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। অসুখে মিলেভার ছোট মেয়ে লিজারলকে হারানো তার জন্য আরো ভয়ানক ছিল। তার এবং অ্যালবার্টের বিয়ের আগে তাদের মেয়ের জন্ম হয়েছিল যার অস্তিত্ব অ্যালবার্ট পরবর্তীতে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন।
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত তার বোনের জন্য মিলেভার বাবা-মা যে ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিয়েছেন সেই একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে মিলেভাও গিয়েছেন। তার ছোট ছেলেও সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিল এবং তার গলা টিপে ধরেছিল। তার অন্য ছেলে তাকে অবজ্ঞা করেছিল। তিনি এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে বাস করেছেন যখন তিনি হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে সময় কাটিয়েছেন। এমন সময়ে যেই মানুষকে তিনি ভালোবেসেছিলেন, সেই অ্যালবার্টও তার হৃদয় ভেঙ্গেছিলেন যখন তিনি মিলেভাকে শুধু নিজের পরিচারিকা বানিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়।
আপনার মতামত জানানঃ