যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট অপরাধমূলক কোনো কাজে জড়িত হলে তাকে সরানোর হাতিয়ার হলো অভিশংসন। যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটলে ‘সহিংসতায় উসকানি’ দেয়ার অভিযোগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিশংসন করেছে দেশটির প্রতিনিধি পরিষদ। বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) ভোরে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অভিশংসনের প্রস্তাব পাস হয়। এর আগে ২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রথমবারের মতো প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসনের সম্মুখীন হন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্পই হলেন একমাত্র প্রেসিডেন্ট যাকে দুইবার অভিশংসন করা হল।
ক্ষমতা থেকে বিদায়ের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ট্রাম্পকে এই লজ্জাজনক পরিণতি ভোগ করতে হলো। এবার ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির বেশ কয়েকজন আইনপ্রণেতাও অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়েছে ২৩১ এবং বিপক্ষে ১৯৭টি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ছিল ২১৭ ভোট।
ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত হাউসে বুধবার কয়েক ঘণ্টার বিতর্ক শেষে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এসময় ক্যাপিটল ভবনের ভেতরে ও বাইরে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পাহারা দিচ্ছিলেন। এদিকে, বাইডেনের অভিষেকের দিন রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিসহ ৫০টি অঙ্গরাজ্যে সশস্ত্র বিক্ষোভের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই।
অভিশংসনের পরে ট্রাম্প একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। এতে তিনি তার সমর্থকদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, যদিও অভিশংসিত হওয়ার বিষয়টি তিনি ভিডিওতে উল্লেখ করেননি। ভিডিওতে ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের দেশে সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের কোনো স্থান নেই। আমার সত্যিকার কোনো সমর্থক কখনোই রাজনৈতিক সহিংসতাকে সমর্থন করতে পারে না।’
অভিশংসনে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভিযোগ আনা হয়েছে, কোনো অপরাধমূলক অভিযোগ নয়। গত ৬ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসের বাইরে একটি র্যালিতে ভাষণে ক্যাপিটল ভবনে হামলায় তিনি উসকানি দিয়েছেন এমন অভিযোগ আনা হয়েছে অভিশংসনে।
৬ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আহ্বানে ওয়াশিংটন ডিসিতে জড়ো হওয়া সমর্থকদের তাণ্ডবে ক্যাপিটল ভবন রক্তে রঞ্জিত হয়। ঝরে পড়ে পাঁচটি তাজা প্রাণ। কংগ্রেসের অধিবেশনে যখন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনকে প্রত্যয়িত করা হচ্ছিল, তখনই মার্কিন ইতিহাসের ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটে। লোকজন দরজা–জানালা ভেঙে ক্যাপিটল হিলে ঢোকে এবং অফিস তছনছ করে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আহ্বানে সারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমর্থকদের সমাবেশ ঘটেছিল ওয়াশিংটন ডিসিতে।
কংগ্রেসের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী প্রতিনিধি পরিষদে পাস হওয়া অভিশংসন প্রস্তাবটি এখন সিনেটে যাওয়ার কথা। সিনেটে রিপাবলিকান পার্টির নেতা মিচ ম্যাককনেল এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, প্রস্তাবটি ট্রাম্পের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সিনেটে আলোচনায় আসবে না।
মিচ ম্যাককনেল বলেছেন, দেশের জন্য এখন নতুন প্রশাসনের ক্ষমতাগ্রহণ সাবলীল হওয়াটাই জরুরি। দেশের স্বার্থে প্রতিনিধি পরিষদে গৃহীত অভিশংসন প্রস্তাবটি নিয়ে সিনেটে আলোচনায় উঠবে ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পরই।
গতকাল কংগ্রেসে দিনভর টানা বিতর্কে ক্ষুব্ধ আইনপ্রণেতারা একের পর এক ডোনাল্ড ট্রাম্পের লজ্জাহীন আচরণ নিয়ে কথা বলেন। ট্রাম্প সংবিধানের নামে নেওয়া শপথ ভঙ্গ করেছেন উল্লেখ করে তারা বলেছেন, ট্রাম্পের হাতে আমেরিকার গণতন্ত্র পদদলিত হয়েছে। খারাপ নজির সৃষ্টি হয়েছে। ১০ জন রিপাবলিকান সদস্যদের কণ্ঠেও ছিল একই বক্তব্য। তারা বলেছেন, এখন দল করার সময় নয়। দেশের গণতন্ত্রের ওপর এমন আঘাতের সময় দলের অবস্থানের বাইরে দাঁড়িয়ে তারা ইমপিচমেন্টের পক্ষে তাদের ভোট প্রদানের কথা জানান।
রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের মধ্যে যারা অভিশংসনের বিপক্ষে বলেছেন, তাদের বক্তব্য ছিল শুধু রাজনৈতিক কারণেই এমন প্রস্তাব নেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বিভক্ত রাজনৈতিক সময়ে এমন অভিশংসন প্রস্তাব দেশের জন্য ভালো পরিণাম নিয়ে আসবে বলে তারা মনে করেন না। আইনপ্রণেতারা সহিংসতা এবং নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার জন্য ট্রাম্পের ভুয়া দাবির সমালোচনা করেন।
অভিশংসনের নিবন্ধে বলা হয়, ‘ট্রাম্প বারবার মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছেন যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে জালিয়াতি হয়েছে এবং এই ফলাফল গ্রহণযোগ্য নয়।’
সেখানে আরও বলা হয়, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র ও এর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা গুরুতরভাবে ব্যহত করেছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সততাকে হুমকির মুখে ফেলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যহত করেছেন এবং সরকারের সমতুল্য একটি শাখাকে বিপন্ন করেছেন।’
প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেন, ‘কয়েক মাসের ব্যবধানে আবারও ট্রাম্পকে অভিশংসন করার জন্য সমবেত হতে গিয়ে আমার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। তবে আমরা ইতিহাসকে এড়িয়ে যেতে পারি না। আসুন, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করি এবং আমাদের জাতির আস্থাকে সম্মান করি। ট্রাম্প জাতির জন্য স্পষ্ট ও বর্তমান হুমকি।’
২০১৯ সালেও ট্রাম্পকে অভিশংসন করেছিল প্রতিনিধি পরিষদ। পরে রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত সিনেটে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এর আগে ট্রাম্প ছাড়াও বিল ক্লিনটন ও অ্যান্ড্রু জনসনকে অভিশংসন করেছিল প্রতিনিধি পরিষদ। সিনেটে তাদেরও খালাস দেওয়া হয়। সিনেটে প্রেসিডেন্টকে দোষী সাব্যস্ত করতে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় সেটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
ক্যাপিটল ভবনে সহিংসতায় উস্কানি ও সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে ট্রাম্প এবার সংসদের উচ্চকক্ষ সিনেটেও শাস্তি পেতে পারেন। অবশ্য ২০ জানুয়ারি তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সিনেটে শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ম্যাককনেল বলেছেন, সিনেটের জরুরি অধিবেশন ডাকতে ১০০ সদস্যের সবার সম্মতি প্রয়োজন।
তবে ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও তার বিচার শুরু হতে পারে। তখন ট্রাম্প ক্ষমতায় না থাকায় তাকে অভিশংসন করা হবে না। কিন্তু তাকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে যেসব সুবিধা পাওয়ার কথা, তা কেড়ে নেওয়া হতে পারে। এবার রিপাবলিকান দলের ১৭ জন সিনেটর প্রস্তাবে সমর্থন দিলেই প্রস্তাবটি পাস হতে পারে। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ২০ জনের মতো রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রস্তাবে সমর্থন দিতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক কোনো প্রেসিডেন্টের বিচার সিনেটে হয়নি। কোনো কোনো সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলছেন, সাবেক কোনো প্রেসিডেন্টের বিচার সিনেট করতে পারে না। এর আগে সিনেটে যারা বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ