ভারত ভ্রমণ নিয়ে পর্যটকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিশাল এই দেশ ভ্রমণ করে কেউ প্রেমের কথা বলেন, আর কেউ প্রকাশ করেন ঘৃণা। তবে গত সপ্তাহে একজন স্প্যানিশ পর্যটককে গণধর্ষণের ঘটনায় ভারত নিয়ে পর্যটকদের ভীতি নতুন মাত্রা পেয়েছে।
জানা যায়, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খন্ডের দুমকা জেলায় সাতজন পুরুষ ওই স্প্যানিশ নারীকে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নির্যাতন করেন। মারধর করা হয় ধর্ষিত নারীর স্বামীকেও। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে অভিযুক্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছে ভারতীয় পুলিশ।
নির্যাতনের শিকার ওই পর্যটক জুটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিন লাখের বেশি ফলোয়ার রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি মোটরবাইকে চড়ে বিশ্বভ্রমণ এবং ভ্লগিং করতে বেরিয়েছিলেন। হামলার রাতে কাছাকাছি কোনো হোটেল না পেয়ে তাঁরা ঝাড়খন্ডের দুমকা জেলার একটি প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁবু টাঙিয়ে রাতটুকু পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন।
আলোচিত ওই ধর্ষণের ঘটনাটি ভারতসহ বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভারতে নারীদের ভ্রমণ নিয়ে অনেক নেতিবাচক মতামত দিচ্ছেন। তবে ভারতের পর্যটন বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের আতঙ্ক দূর করার জন্য চেষ্টা করছেন।
যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) মতে, ঝাড়খন্ডের গ্রামীণ যে এলাকাটিতে হামলার ঘটনাটি ঘটেছে, সেই এলাকাটি ভারতের ‘হিংসাত্মক অপরাধের’ ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই এ ধরনের এলাকা ভ্রমণের ক্ষেত্রে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রায় ২০ বছর ধরে ভারতে কাজ করা ওয়াইল্ড ফ্রন্টেয়ার্সের মালিক জনি বেলবি বলেন, ‘এই ঘটনাটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। কারণ, ওই নারী তাঁর স্বামীর সঙ্গে ছিলেন।’
ভারত অন্য দেশের তুলনায় বেশি বিপজ্জনক কি না—সেই বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন বেলবি। তিনি বলেন, ‘আপনাকে বিপদগুলো সম্পর্কে সচেতন এবং বিচক্ষণ থাকতে হবে। অন্য যেকোনো জায়গায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে যতটুকু সতর্কতা অবলম্বনের দরকার হয়, ভারতেও ততটুকু সতর্ক থাকতে হবে।’
পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংস অপরাধের মাত্রা ঐতিহাসিকভাবেই বেশি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রায় সময়ই এ ধরনের অপরাধ মোকাবিলায় দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন।
তারপরও সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৯০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ১৪০ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটিতে ২০২২ সালে ৩১ হাজার ৫১৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যদিও প্রকৃত সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি হবে বলেই মনে করে সব পক্ষ।
ভারতে বিদেশিদের বিরুদ্ধে সহিংস অপরাধও ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বেশি দেখা গিয়েছিল। ২০২১ সালে এ ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটেছিল ১৫০টি। আর ২০২২ সালে ১৯২টি ঘটনা ঘটেছিল। তবে এটাও ঠিক যে ২০২১ সালে করোনার কারণে দেশটিতে যেখানে ১৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ ভ্রমণ করেছে, সেখানে ২০২২ সালে ভ্রমণ করেছে ৬১ লাখ ৯০ হাজার মানুষ।
এ বিষয়ে এক নিবন্ধে যুক্তরাজ্যের টেলিগ্রাফ পত্রিকাটি ক্রিস্টিনা ডেভিস এক নারীর সঙ্গে কথা বলেছে। ৪৭ বছর বয়সী এই নারী বিদেশি হিসেবে গত ২১ বছর ধরে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বসবাস করেছেন এবং দেশটির ভ্রমণশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
ক্রিস্টিনা বলেন, ‘ভারতে ২১ বছরে আমি কখনই উদ্বিগ্ন বোধ করিনি। কোনো ক্লায়েন্টেরও এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। যদি ভারতে ভ্রমণকারীরা সরকারি এবং ট্যুর অপারেটরের পরামর্শ গ্রহণ করে, তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তাদের কোনো সমস্যা নেই।’
সাম্প্রতিক ঘটনার বিষয়ে ক্রিস্টিনা বলেন, ‘অবশ্যই এই হামলাটি ভয়ংকর। ঝাড়খন্ডের দুমকা জেলায় এটি হওয়ার কথা ছিল না। সেখানে আরও কিছু বিদেশি অবস্থান করছিল এবং যাওয়ার পথে ছিল। আপনি হিমালয়ে ট্রেকিং করলে ক্যাম্প করতে পারেন, তবে ভারতে সাধারণত এভাবে ক্যাম্প করে না। এই ঘটনাটি ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে বুকিংয়ের গুরুত্বকে নির্দেশ করছে।’
বেলবিও এ বিষয়ে একমত। তিনি বলেন, ‘কেউ অ্যাডভেঞ্চারের আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে চায় না। তবে আপনাকে অবশ্যই নিরাপদ পদ্ধতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।’
ট্যুর অপারেটরের গাইড ছাড়া ভারতে কোথাও গেলে যতটা সম্ভব স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বেলবি। এ ছাড়া ভারত ভ্রমণ নিয়ে অসংখ্য পর্যটকের অভিজ্ঞতা সংবলিত অনেক বইও রয়েছে বলে জানান তিনি। সবশেষে বেলবি বলেন, ‘ভারতে যেতে ভয় পাওয়া উচিত নয়।’
আপনার মতামত জানানঃ