যেসব সংগঠন ইসলামী আন্দোলন করছে, তাদের বিরুদ্ধে শত্রুর সাথে “গোপন” সম্পর্ক রাখার অভিযোগ একেবারে নতুন কিছু নয়। এই অভিযোগগুলো ছড়ানোর মাধ্যমে সাধারণত তাদের বিরোধীরা কিছু সুবিধা পায়। এমনকি তাদের জনপ্রিয়তা বা তাদের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করতেও এসব অভিযোগ কাজে আসে।
অনেক সশস্ত্র আন্দোলনের গোপন ইতিহাসও এ ধরনের অভিযোগের পক্ষে আগ্রহ তৈরি করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ইসলামিক রেসিসট্যান্স মুভমেন্ট বা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন “শুরুতে একটি ইসরায়েলি প্রকল্প ছিল”।
এই দাবিটি বিভিন্ন সময়ে মানুষের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। গত বছর ৭ই অক্টোবর ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের ইসরায়েলে হামলা এবং পরবর্তীতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর স্থল ও বিমান হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর এই দাবিটি আবার সামনে এসেছে।
কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের সদস্যরা দৃঢ়ভাবে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। ইসরায়েলের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা, এই অভিযোগকে অসঙ্গত বলে দাবি করেছেন।
এবারে প্রশ্ন উঠেছে – হামাসের উৎপত্তি এবং ইসরায়েলের সাথে তাদের কথিত সংযোগ থাকার বাস্তবতা সম্পর্কে। এই প্রশ্নে অনেকেই অবাক হতে পারেন, তবে কঠিন হলেও সত্য যে এই অভিযোগ অনেক পুরনো এবং দুই পক্ষের ওপরে এই অভিযোগ সমানভাবে বর্তায়।
এমনকি ইসরায়েলে হামাসের হামলার এক মাস আগে বিবিসি টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে সাবেক ফিলিস্তিনি মন্ত্রী এই দাবিটি তুলে ধরেছিলেন। যার পরে অনেক বিদেশি সংবাদপত্রে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে একই দাবির পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, কয়েক দশক আগে মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক প্রকাশ্যেই এই দাবিটি তুলে ধরেছিলেন। এছাড়া মার্কিন কংগ্রেসে এক রিপাবলিকান সেনেটরও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। ইসরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেটের কর্মকর্তারাও অভিযোগ তুলেছেন।
তবে শুধু হামাস সদস্যরা নয়, ইসরায়েলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ ধরনের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং একে ‘ভিত্তিহীন’ বলেছেন। কিন্তু, এই দাবির সত্যতা কী? কিসের ভিত্তিতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? হামাসের সামরিক ইতিহাসের কোন পর্যায়ে এই সন্দেহ দেখা দিয়েছে? বিবিসির অ্যারাবিক সার্ভিস থেকে নেয়া নিবন্ধে, এই বিশাল রহস্যের অনুসন্ধান করা হয়েছে এবং এর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
হামাসের দীর্ঘ প্রচেষ্টা
এটা উল্লেখ করা উচিত যে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন বা হামাস রাতারাতি আবির্ভূত হয়নি। এটি গঠনের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই যাত্রাকে মোটা দাগে দুটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে।
প্রথম অংশ: ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ফিলিস্তিন অঞ্চলে হামাস বা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা গিয়েছিল।
ফিলিস্তিনের গাজা, জেরুসালেমের শেখ জাররাহ অঞ্চল এবং অন্যান্য শহরে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রথম শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
বলা যায়, ওইসময় থেকেই ফিলিস্তিনি অঞ্চলে এই আন্দোলনের শিকড় তৈরি হয়। দ্বিতীয় অংশ: ১৯৬৭ সালে তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ বা ছয়দিনের যুদ্ধের পর থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডের তরুণ সদস্যদের সাথে আরব শেখ এবং দলের নেতাদের মতানৈক্য দেখা দেয়। (ছয়দিনের যুদ্ধে মিশর/সিরিয়া/জর্ডান এই তিন আরব রাষ্ট্রের জোটের সাথে ইসরায়েলের লড়াই হয়েছিল। যেখানে ইসরায়েল বিজয়ী হয়।)
যার ধারাবাহিকতায় তরুণ ব্রাদারহুড সদস্যদের মধ্যে সামরিকভাবে সংগঠিত হওয়ার ধারণা দানা বাধে। ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ মূল্যায়নের ভিত্তিতে জানিয়েছেন, ফিলিস্তিন অঞ্চলে মুসলিম ব্রাদারহুডের যে ইতিহাস, তার একটি বড় অংশ জুড়ে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।
যেমন মুসলিম ব্রাদারহুডের কার্যক্রমের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল ধর্মীয় মূল্যবোধ, অ্যাডভোকেসি এবং সচেতনতা বাড়ানো। সেইসাথে তারা ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ নির্মাণে গুরুত্ব দিয়েছিল।
মুসলিম ব্রাদারহুডের এ ধরনের তৎপরতা দেখে ধারণা করা যায়, ফিলিস্তিনে যখন তারা সংগঠিত হচ্ছিল বা কার্যক্রম চালাচ্ছিল তখন তারা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে তাদের উদ্দেশ্য সামরিকভাবে সংগঠিত হওয়া ছিল না।
বরং তারা বেশি মনোযোগ দিয়েছিল ফিলিস্তিনিদের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের দিকে। এই প্রসঙ্গে, হামাসের প্রাক্তন ও অন্যতম প্রধান নেতা খালেদ মেশাল, যিনি এখন ফিলিস্তিনের বাইরে থাকেন- তিনি বলেছেন,
“১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে ওই অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী, নাসেরবাদী (পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, আরব জাতীয়তাবাদ মতাদর্শ) বাথিস্ট (আরব জাতির ঐক্যের মতাদর্শ) এবং কমিউনিস্ট বা বামপন্থীরা ফিলিস্তিনের ক্ষমতায় আসে এবং ফিলিস্তিন জুড়ে তাদের আধিপত্য ছিল।”
কমিউনিস্ট নেতারা ফিলিস্তিনের ক্ষমতায় আসায় ইসলামপন্থীদের উপর তাদের চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং তারা এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এ কারণে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা ফিলিস্তিন থেকে কিছু সময়ের জন্য সরে থাকতে বাধ্য হয়।
কারণ তারা ওইসব মতাদর্শের অংশ ছিল না। ওইসব অঞ্চলে ইসলামপন্থীদের উপস্থিতিকে স্বাগত জানানো হয়নি, এমনকি তাদের জন্য চাকরির কোনো সুযোগ ছিল না, মিশালের প্রেস বিবৃতি উল্লেখ করা হয়।
এই নিবন্ধের বাকি অংশে, হামাস গঠনের পথে দ্বিতীয় স্তরের সংগ্রামের ইতিহাস ব্যাখ্যা করা হবে, অর্থাৎ ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে হামাস আন্দোলন শুরু হওয়ার বছর পর্যন্ত।
লাল মিনার: “সশস্ত্র সংগ্রামের” প্রতীক
১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোর পরাজয়ের পরে “ইসরায়েলের সাথে সংঘাত” পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসে এবং এই সংগ্রাম নতুন রূপ নিতে শুরু করে বলে মনে করা হয়।
হামাস আন্দোলনের প্রথম মুখপাত্র এবং তাদের সাবেক নেতা ইব্রাহিম ঘোষেহ, তার “দ্য রেড টাওয়ার” শিরোনামের স্মৃতিকথায় এই পরাজয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিক্রিয়া এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের তরুণদের উপর এই আন্দোলনের প্রভাব ব্যাখ্যা করেছেন।
ঘোষেহ তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন, সেই সময়ে জর্ডানে ব্রাদারহুডের সমন্বয়কারী বা জেনারেল কন্ট্রোলার, মুহাম্মদ আবদ আল-রহমান খলিফা একটি ইসলামী সম্মেলন করেছিলেন।
সেই সম্মেলন যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে তা নিয়ে ঘোষেহ এবং তার প্রজন্মের তরুণরা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। “কারণ সেখান থেকে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যতের জন্য কোন সুস্পষ্ট সমাধান আসেনি, এবং ইসলামিক জিহাদি সংগঠন গঠন করার বিষয়ে কোন আহ্বান জানানো হয়নি।”
“দ্য রেড টাওয়ার” শীর্ষক স্মৃতিকথায় আরও বলা হয় যে, এই ব্যাপারটি ব্রাদারহুডের যুবকদের মধ্যে যারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চেয়েছিল তাদের উস্কে দেয়।
তারা দলের মধ্যে একটি “সংস্কার আন্দোলন” শুরু করতে চেয়েছিল এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের না জানিয়ে নিজেরাই অস্ত্র হাতে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিল।
ফলস্বরূপ, তিনি গোপনে আল-ফাতাহ মুভমেন্টের সাথে জর্ডানে মুসলিম ব্রাদারহুডের তরুণ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সশস্ত্র অভিযানের জন্য প্রস্তুত করতে রাজি হন।
সেই সময়ে জর্ডানে এই প্রস্তুত করার কৌশলটি “শেখদের নিয়ম” হিসাবে পরিচিত ছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭০ সালে জর্ডানের ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ বা জর্ডানের গৃহযুদ্ধের সাথে সাথেই তা শেষ হয়ে যায়।
এর কারণ ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড নেতারা নিজেদের মধ্যে একটি ‘সংস্কার আন্দোলন’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের আন্দোলন চলাকালে তাদের “প্রবীণ নেতা” এবং “তরুণ প্রজন্মের” মধ্যে তীব্র মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব বেধে যায়।
তরুণরা যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ বেছে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল, তখন নেতারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেয়ে “রাষ্ট্র গঠন”কে অগ্রাধিকার দেওয়ার উপর জোর দিচ্ছিল।
এ কারণে ওই সংগঠনের বেশ কয়েকজন তরুণ সদস্য দল ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং ‘জাতীয় ও সংগ্রামী আন্দোলন’ গড়ে তোলে যা তাদেরকে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
কিন্তু এই তরুণদের উপর চাপ বাড়তে থাকে।
কারণ তাদের বিরোধীরা সংখ্যায় বেশি ছিল এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় আন্দোলনের আধিপত্যের তুলনায় তাদের অবস্থান ছিল বেশ দুর্বল।
“ইয়াসির আরাফাতকে মোকাবিলা করতে হামাসের উৎপত্তি”
১৯৭০ এবং ১৯৮০-এই দুই দশকে যখন তরুণদের সশস্ত্র সংগঠনটি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তখনই ইসরায়েল এবং ইসলামিক গোষ্ঠী যেখান থেকে হামাসের উত্থান হয়েছিল তাদের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে এমন সন্দেহ দেখা দেয়।
মূলত ইসরায়েল এবং তৎকালীন ইসলামপন্থী নেতাদের মধ্যে ‘সম্পর্ক’ রয়েছে এমন সন্দেহ থেকে এই আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। যারা এই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক। তিনি হামাস আন্দোলনকে ইসরায়েলি সৃষ্টি বলে অভিহিত করেছিলেন।
মিশরীয় সামরিক বাহিনীর সাথে বৈঠকে মুবারকের একটি পুরানো ভিডিও রয়েছে, যেখানে তিনি বলেছিলেন: “’ইসরায়েল হামাসকে পিএলও-এর (প্যালেস্টাইন লিবারেশন মুভমেন্ট) বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য তৈরি করেছে। যার নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াসির আরাফাত।
এই অভিযোগ শুধু হোসনি মোবারক একা করেননি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের প্রাক্তন সদস্য রন পল, যিনি ১৯৮৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী ছিলেন।
তিনি ২০০৯ সালে মার্কিন কংগ্রেসে বলেছিলেন “আপনি যদি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকান, আপনি জানেন যে হয়তো ইয়াসির আরাফাতকে মোকাবেলা করার জন্য ইসরাইল হামাসকে তৈরি করতে চেয়েছিল এবং তারা (ইসরায়েল) হামাসকে তৈরি করতে সহায়তা করেছিল।”
এছাড়া, হাসান আসফোর যিনি ফিলিস্তিনের সাবেক মন্ত্রী এবং ১৯৯৩ সালে গোপন অসলো আলোচনায় ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন। তিনি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিবিসি টেলিভিশনকে বলেছিলেন যে “হামাস মূলত একটি মার্কিন পরিকল্পনার অংশ। কিছু আরব দেশ, ইসরায়েল এবং পিএলও এর মধ্যে চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যারা কিনা ফিলিস্তিনে পিএলও এর সমান্তরাল বিকল্প হতে পারবে।”
এই বিষয়ে ফিলিস্তিনি গবেষক, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমেদ জামিল আজম বলেছেন, এসব অভিযোগ নতুন কিছু নয়।
তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজনের দাবিকে ইন্ধন দেওয়ার জন্য ইসরায়েলিরা নিজেরাই এই অভিযোগগুলিতে ভূমিকা পালন করেছে।”
আপনার মতামত জানানঃ