মহাজগতের বহুদূরের একটি ছায়াপথ থেকে আসা রহস্যজনক সংকেত পাওয়ার বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। কানাডার একটি টেলিস্কোপে ওই সংকেত ধরা পড়েছে। তবে সংকেতের অর্থ বা কোথা থেকে সেটি আসছে, তা এখনো বিজ্ঞানীরা বের করতে পারেননি।
এই শব্দ তরঙ্গকে এফআরবি বলে বর্ণনা করে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, শব্দটি প্রায় ১৫০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো উৎস থেকে আসছে।
এ ধরনের ঘটনা অতীতে আরেকবার ঘটেছে, সেটি আরেকটি টেলিস্কোপের মাধ্যমে জানা গিয়েছিল। প্রথম সংকেতটি এসেছিল ২০১৫ সালে। এরেসিবো রেডিও টেলিস্কোপে তা ধরা পড়ে। ২০১৮ সালের শেষে আবার ধরা দিয়েছে সংকেতটি। কানাডায় অবস্থিত একটি অবজারভেটরি টেলিস্কোপে এটি ধরা পড়েছে।
একসঙ্গে অনেক তরঙ্গের মধ্যে কয়েকটি একই রকমের। এই ধরনের রেডিও সংকেত থেকে মহাকাশের গোলকধাঁধার রহস্যভেদ করার কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইনগ্রিড স্টেয়ারর্স বলছেন, ‘এটা জানার পর আরেকবার এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, মহাবিশ্বের অন্য কোথাও কিছু রয়েছে।’
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ওকানাগান উপত্যকায় চারটি ১০০ মিটার লম্বা অ্যান্টেনা নিয়ে শাইমি গবেষণাগারটি অবস্থিত, যেখানে এই সংকেত ধরা পড়েছে। এই গবেষণাগার থেকে প্রতিদিন আকাশে অনুসন্ধান চালানো হয়।
গত বছর এই টেলিস্কোপটি কাজ শুরু করার পর মহাবিশ্বের ১৩টি মহাজাগতিক বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েছে, যার মধ্যে একটি কয়েকবার ফিরে ফিরে এসেছে। সম্প্রতি ‘ন্যাচার’ পত্রিকায় এই গবেষণার তথ্যটি প্রকাশিত হয়।
ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শ্রীহর্ষ টেন্ডুলকার বলেন, ‘আমরা দ্বিতীয়বারের মতো একটি সংকেতের পুনরাবৃত্তি পেয়েছি, দ্বিতীয় সংকেতটি একেবারে প্রথমটির মতোই ছিল।’
তার মতে, পুনরাবৃত্তির জন্য ওই সংকেতটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছে। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এরকম ৬০টি একক, দ্রুতগতির বিস্ফোরণের বেতার তরঙ্গ শনাক্ত করতে পেরেছেন, যার মধ্যে দুটির পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এই পুনরাবৃত্তিই মহাকাশে প্রাণ নিয়ে গবেষকদের আরও কৌতূহলী করে তুলেছে।
মহাকাশে বাসযোগ্য গ্রহের অনুসন্ধান করে নাসার টেলিস্কোপ কেপলার। ২০১৬ সালে এই টেলিস্কোপটি নাসার বিজ্ঞানীদের উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছিল। কারণ গুরুত্বপূর্ণ এই টেলিস্কোপটি ওই বছরের ৭ এপ্রিল মহাকাশে তার অবস্থান থেকে সরে গিয়ে পৃথিবী থেকে ৭৫ মিলিয়ন মাইল দূরে ‘ইমার্জেন্সি মোডে’ চলে গিয়েছিল। এ সময় ‘ক্যাম্পেইন নাইন মিশন’-এ ছিল কেপলার। ইমার্জেন্সি মোড হচ্ছে, ‘সর্বনিম্ন কর্মক্ষম অবস্থা’।
বহু দূরে চলে যাওয়ায় পৃথিবী থেকে আলোর গতিতে সিগন্যাল যাওয়া আসা করার পরও কেপলারের কাছে বার্তা পাঠাতে ও প্রতি বার্তা পেতে সময় লাগত প্রায় ১৩ মিনিট। কিন্তু সেই সিগন্যালও ঠিকঠাক কাজ করছিল না।
ফলে সম্ভাব্য সমাধানই নিয়ে ভাবতে ভাবতে দিশেহারা হয়ে পড়ছিলেন নাসার বিজ্ঞানীরা। এমন দূরত্বে থাকা টেলিস্কোপটি মেরামত করাও প্রায় অসম্ভব মনে করা হচ্ছিল। আশঙ্কা ছিল, এটি হয়তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কিন্তু হাল ছাড়েননি বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের প্রায় এক সপ্তাহের নিরলস পরিশ্রমে সকল উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা পরিণত হয় সাফল্যের অপরিসীম আনন্দ ও সীমাহীন খুশিতে।
কারণ তারা সফলভাবে টেলিস্কোপটির সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে সফল হয়েছিলেন এবং ইমার্জেন্সি মোড থেকে বের করে আনতেও সক্ষম হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে কেপলার টেলিস্কোপটি মহাশূন্যে পাঠায় নাসা। ছায়াপথগুলোর মধ্যে নতুন নতুন গ্রহের অনুসন্ধান আর এসব গ্রহে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব আছে কি-না সেই দুরূহ কাজটিই করে কেপলার। ২০১২ সালের মধ্যেই কেপলার তার প্রাথমিক লক্ষ্যপূরণ করে ফেলে। আবিষ্কার করে সৌরজগতের বাইরে থাকা প্রায় পাঁচ হাজার গ্রহ।
পৃথিবীর দ্বিতীয় নিকটতম নক্ষত্র বার্নার্ডস। আর এই নক্ষত্রকেই কেন্দ্র করে ঘুরছে ‘বার্নার্ড বি’ নামের গ্রহটি। গবেষকরা বলছেন, এই গ্রহেই থাকতে পারে প্রাণের অস্তিত্ব। যদিও এটির তাপমাত্রা খুবই কম, আমাদের সৌরম-লের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপার মতোই মাইনাস ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কিন্তু গবেষকরা বলছেন, এই গ্রহের কেন্দ্রে গলিত লোহা বা নিকেলের স্তর থাকতে পারে। আর এ জন্য এই গ্রহের কেন্দ্রস্থল যথেষ্ট উষ্ণ। কেন্দ্রের এই উষ্ণতাই গ্রহটিতে প্রাণের সঞ্চার করতে পারে। আমেরিকার ভিয়ানোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট এডওয়ার্ড গুইনান এক্ষেত্রে এন্টার্কটিকা মহাদেশের উদাহরণ টানেন। এন্টার্কটিকার লেকগুলো সারা বছরই বরফাচ্ছন্ন থাকে। কিন্তু এটি আসলে উপরিভাগের দৃশ্য। এই বরফের নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে তরল জল। এই জলে রয়েছে প্রাণের বিচরণ।
গুইনানের মতে, এন্টার্কটিকার এসব লেকের মতোই বার্নার্ড বি’র সমুদ্রগুলো জমে বরফ হয়ে গেলেও জিওথার্মাল উষ্ণতায় এর নিচ দিয়ে জল প্রবাহিত হচ্ছে। আর এই জল প্রাণসঞ্চারের জন্য যথেষ্ট অনুকূল। বার্নার্ড বি গ্রহটির ভূপৃষ্ঠ খুব উঁচু-নিচু। আর এটি আমাদের পৃথিবীর চেয়ে তিনগুণেরও বেশি বড়। ২৩৩ দিনে এই গ্রহটি নিজের নক্ষত্রের চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করে।
এটি যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, তা আমাদের সূর্যের চেয়ে ছোট হলেও বয়সে দ্বিগুণ। আমাদের সূর্যের বয়স প্রায় ৪৬০ কোটি বছর, আর বার্নার্ড বি যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, তার বয়স প্রায় ৯০০ কোটি বছর। আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে নিকটতম নক্ষত্র আলফা সেন্টাউরি। আর এরপরই অবস্থান করছে বার্নার্র্ডস। দ্বিতীয় নিকটবর্তী নক্ষত্র হলেও এর সৌরমন্ডল পৃথিবী থেকে ছয় আলোকবর্ষ দূরে।
আপনার মতামত জানানঃ