ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত আজ সোমবার ৩৭তম দিনে পড়েছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ১১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ৪ হাজার ৫০০টির বেশি শিশু রয়েছে।
গত অক্টোবর মাসের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন গাজায় ইসরায়েলি হামলায় শিশুদের প্রাণহানি নিয়ে একটি রোমহর্ষক তথ্য জানায়।
সংস্থাটির তখনকার তথ্যমতে, ২০১৯ সাল থেকে বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোয় নিহত শিশুর বার্ষিক সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে গাজায় তিন সপ্তাহে নিহত শিশুর সংখ্যা।
ইসরায়েল আকাশপথে হামলার পাশাপাশি গাজায় স্থল অভিযান চালাচ্ছে। ফলে গাজায় সাদা কাফনে মোড়ানো ছোট ছোট মৃতদেহের সংখ্যা বেড়ে চলছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে শিশুসন্তান হারানো ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর মাতম।
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় যতসংখ্যক ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, তা সেখানকার হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসলীলার পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রকাশ করে না বলে জানায় আল-জাজিরা।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্য কিছু স্থানে বড় ধরনের সংঘাতে অনেক শিশু প্রাণ হারিয়েছে। এই প্রাণহানির সঙ্গে গাজার চিত্রের তুলনা দেখিয়েছে আল-জাজিরা।
তুলনায় দেখা যায়, সব কটি স্থানের সংঘাতই শিশুদের জন্য ভয়ংকর, বিধ্বংসী হয়ে এসেছে। তবে গাজার বিভীষিকা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। গাজায় শিশুদের প্রাণহানি বেড়েই চলছে। কবে তা থামবে, কারও জানা নেই।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয় গত ৭ অক্টোবর। সেদিন ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস।
ইসরায়েল বলছে, হামাসের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। এ ছাড়া দুই শতাধিক ব্যক্তিকে ইসরায়েল থেকে ধরে গাজায় নিয়ে জিম্মি করে রেখেছে হামাস।
৭ অক্টোবর থেকেই গাজাকে অবরুদ্ধ করে নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। পাশাপাশি তারা গাজায় স্থল অভিযানও চালাচ্ছে।
গত শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুস জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, গাজায় গড়ে প্রতি ১০ মিনিটে একটি করে শিশু নিহত হচ্ছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই তথ্য জানায়।
আল-জাজিরা জানায়, আগে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় বলেছিল, চলমান সংঘাতে গাজায় প্রতিদিন গড়ে ১০০টির বেশি শিশু নিহত হয়েছে।
গাজার আয়তন ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার। মোট জনসংখ্যা ২৩ লাখ। এই হিসাব অনুযায়ী, গাজায় জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৬ হাজার ৩০০ জন।
জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্যমতে, গাজার জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ শিশু।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের এক বছর আট মাস পেরিয়ে গেছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত অব্যাহত। চলমান এই যুদ্ধে অনেক বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন।
সংঘাতে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫১০টি শিশু রয়েছে। চিলড্রেন অব ওয়ার নামের একটি ওয়েবসাইট এই তথ্য জানিয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের পক্ষে দেশটির সরকার প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করেছে।
উল্লিখিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউক্রেনে গড়ে প্রতিদিন একটির চেয়ে সামান্য কম শিশু নিহত হয়েছে।
তবে এই তথ্য ইউক্রেনের ভেতরকার। রাশিয়ার দখল করা ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলোয় শিশুদের প্রাণহানির তথ্য অজানা। ফলে এই যুদ্ধে নিহত শিশুর সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি হবে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ইউক্রেনের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৭৬ জন। ইউনিসেফের তথ্যমতে, ইউক্রেনের জনসংখ্যার ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু।
২০০৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে ইরাকে আগ্রাসন চালায় যুক্তরাষ্ট্র।
২০০৮ সাল থেকে এই অঞ্চলে শিশুদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে ইউনিসেফ।
২০০৮ থেকে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ, অর্থাৎ ১৪ বছর ধরে এ-সংক্রান্ত তথ্য ইউনিসেফ নথিভুক্ত করে।
এই সময়কালে সহিংসতায় ৩ হাজার ১১৯ শিশু নিহত হয় বলে জানায় ইউনিসেফ। অর্থাৎ, প্রতি দুই দিনে একজনের বেশি শিশু নিহত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ইরাকের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০০ জন। ইউনিসেফের তথ্যমতে, ইরাকের মোট জনসংখ্যার ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু।
২০১১ সালের মার্চ মাসে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। তাঁর সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের দমন-পীড়নে সহিংস পন্থা বেছে নেয়। এর জেরে সিরিয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
২০১১ সালে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সিরিয়ায় ১২ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিনটি শিশু নিহত হয়েছে।
তবে শিশু নিহত হওয়ার প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্যমতে, শিশু নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার বলে ধারণা করা হচ্ছে। তেমনটা হলে গত ১২ বছরে সিরিয়ায় প্রতিদিন গড়ে ৭ জন শিশু নিহত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, সিরিয়ার জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১১৬ জন।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, সিরিয়ার জনসংখ্যার ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু।
আরব বসন্তের জেরে ২০১১ সালে ইয়েমেনে অস্থিরতা শুরু হয়। ২০১৫ সালে মানসুর হাদির সরকার হটিয়ে রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নেয় ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা। মানসুর হাদির সমর্থনে হুতিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। এতে ইয়েমেন সংঘাত চরম আকার ধারণ করে।
ইয়েমেনে সাত বছর ছয় মাসের সংঘাতে ৩ হাজার ৭৭৪ শিশু নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। অর্থাৎ প্রতি তিন দিনে চারটি শিশু নিহত হয়েছে।
জাতিসংঘ যে তথ্য যাচাই করতে পেরেছে, তার ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। তবে ইয়েমেনে শিশু নিহত হওয়ার প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি হবে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ইয়েমেনের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৬২ জন। ইউনিসেফের তথ্যমতে, ইয়েমেনের জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশই শিশু।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা হয়। এই হামলার জেরে একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী আফগানিস্তানে আগ্রাসন শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়।
আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়তা মিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ৮ হাজার ৯৯ শিশু নিহত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন ২টি শিশু নিহত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, আফগানিস্তানের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৬১ জন। ইউনিসেফের তথ্যমতে, আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ শিশু।
আপনার মতামত জানানঃ