মাটির নিচে জালের মতো ছড়ানো টানেল। সেখানেই সব অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, ক্ষেপণাস্ত্র, খাদ্য, মেডিকেল সরঞ্জাম। সেখানেই গাজার যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাসের অবস্থান। তাদের আছে ৪০ হাজার সদস্যের বিশাল বাহিনী। তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করছে নিজেদের ভূমির স্বাধীনতার দাবিতে। নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে।
বিভিন্ন বার্তা সংস্থার মতে তারা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছেন। ইসরায়েলি সেনাদের মুখোমুখি তারা লম্বা সময় টিকে থাকতে পারবে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে। এসব করে তারা ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে। হামাসের ঘনিষ্ঠ দুটি সূত্র এসব তথ্য দিয়েছেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে।
তাদের একজন বলেছেন, এই গ্রুপের যোদ্ধারা গাজা শহরের নিচ দিয়ে প্রবাহিত টানেলের ভেতর কয়েক মাস টিকে থাকতে পারবেন। যেন গাজার মাটির নিচে আরেক গাজা। সেখানকার ছোঁয়া পাচ্ছে না ইসরায়েল। তাদের ভয়ে স্থল অভিযানে অগ্রসর হতেও কাচুমাচু করছে তার সেনারা। প্রস্তুতি নিয়ে হামাস ইসরায়েলি বাহিনীকে হতাশ করে দিতে চায়।
তাদের গেরিলা কৌশলের কাছে ইসরায়েলি অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে চায়। হামাস মনে করে গাজায় অবরোধ ও দখলদারিত্ব বন্ধে ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে। বেসামরিক জনগণ হতাহত হওয়ার প্রেক্ষিতে এই চাপ বাড়বে। এতে যুদ্ধবিরতিতে আসতে বাধ্য হবে ইসরায়েল। এমনকি তারা সমঝোতায় আসবে। যদি তা হয়, তাহলে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে ফিলিস্তিনি হাজার হাজার বন্দির মুক্তি দাবি করবে তারা।
এরই মধ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে পরোক্ষভাবে এটা পরিষ্কার করেছে যে, কাতারের মধ্যস্থতায় জিম্মি মুক্তি নিয়ে আলোচনায় বন্দিবিনিময় থাকতে হবে। হামাসের চারজন কর্মকর্তা, একজন আঞ্চলিক কর্মকর্তা ও হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা এমনটাই মনে করেন।
দীর্ঘমেয়াদে হামাস চায় গাজায় ইসরায়েলের ১৭ বছরের অবরোধের ইতি। ইসরায়েলি বসতি স্থাপন সম্প্রসারণ বন্ধ। আল আকসা মসজিদে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কঠোর পদক্ষেপের ইতি। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, গাজা ভয়াবহ গণহত্যার ঝুঁকিতে।
এই সংকট বৃদ্ধি ও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলেও অনেক বিশেষজ্ঞের মতে কোনো পক্ষই যুদ্ধ শেষ করার ইঙ্গিত দিচ্ছে না। বর্তমানে ওয়াশিংটনে কার্নেই এন্ডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসে কাজ করেন জর্ডানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী মারওয়ান আল মুয়াশের। তিনি বলেন, হাসাসকে অতো সহজে ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব নয়। এই যুদ্ধের কোনো সামরিক সমাধান নেই। স্বল্পসময়ে এই যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না।
৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের রকেট হামলার পর গাজার ওপর ইসরায়েল বোমাবৃষ্টি বর্ষণ করে চলেছে। এতে হামাস ধ্বংসের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যারা মারা যাচ্ছেন গাজায় তাদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ- নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। ইসরায়েলের বোমা থেকে রেহাই পাচ্ছে না গাজার স্কুল, হাসপাতাল, সাধারণ বসতি, মিডিয়ার অফিস। সর্বত্র উন্মত্তের মতো বোমা হামলা চালিয়ে পুরো গাজাকে তারা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে।
এতে গাজায় নিহতের সংখ্যা ৯০০০ ছাড়িয়ে গেছে। সেখানে সহিংসতার প্রতিবাদে প্রতিদিনই বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে। অন্যদিকে গাজায় কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। তাদের পানি, খাদ্য ও জ্বালানি কিছুই নেই। গত সপ্তাহের মঙ্গলবারে সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির জাবালিয়ায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় প্রায় দুই শত মানুষ নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে হামাসের একজন কমান্ডার আছেন।
হামাসকে নির্মূল করে দেয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। তার কর্মকর্তারা বলেছেন, হামাসের অপারেটিভরা বেসামরিক লোকজনের নেপথ্যে আত্মগোপন করে আছে।
জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং পার্লামেন্ট নেসেটের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক কমিটির সাবেক সদস্য ড্যানি ড্যানন বলেন, দেশ দীর্ঘমেয়াদি এবং বেদনাদায়ক এক যুদ্ধে লিপ্ত। আমরা জানি শেষ পর্যন্ত আমরা বিজয়ী হবো এবং পরাজিত হবে হামাস। প্রশ্নটা হবে তার মূল্য নিয়ে। আমাদেরকে খুব বেশি সতর্ক হতে হবে শহর এলাকায়। এটা খুবই জটিল বিষয়। ওদিকে মানবিক যুদ্ধবিরতির ডাক দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে ৩রা নভেম্বর ইসরায়েল সফর করে এই বার্তা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। তবে তিনি এটাও বলেছেন, আত্মরক্ষার অধিকার আছে ইসরায়েলের।
কাতার ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক ফিলিস্তিনি বিশেষজ্ঞ আদিব জিয়াদেহ বলেন, ইসরায়েলের হামলার জবাব দিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে হামাসের। পুরোপুরি প্রস্তুতি নেয়া ছাড়া হামাসের পক্ষে ৭ই অক্টোবরের মতো হামলা চালানো অসম্ভব। তারা এই হামলার ফল কী হবে সে হিসাবও কষে নিয়েছে। ওয়াশিংটন আশা করে গাজার সড়কে সড়কে যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে মাথানত করবে হামাস। হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন সূত্র একথা বলেছেন। একই সুরে কথা বলেছে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা। তারা মনে করে হামাসের গেরিলা কৌশলের জন্য প্রস্তুত তারা।
তবে ইসরায়েলের বোমা বর্ষণ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং এর মহাসচিব পর্যন্ত গাজা নিয়ে আতঙ্কিত। তারা বার বার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। একটি সূত্র বলেছেন, হামাসকে নির্মূল করে দেয়ার সক্ষমতা ইসরায়েলের আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, হামাসের আছে সক্রিয় ৪০ হাজার যোদ্ধা। তারা মাটির নিচ দিয়ে বিস্তৃত টানেল ব্যবহার করে নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখছেন এবং পাল্টা হামলা চালাচ্ছেন।
এসব টানেল শত শত মাইল দীর্ঘ। কোনো কোনোটি মাটির ৮০ মিটার নিচে। বহু বছর সময় নিয়ে তা বানানো হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার গাজায় হামাসের অপারেটিভদের টানেল থেকে বের হয়ে ইসরায়েলি ট্যাংকে হামলা চালাতে দেখা গেছে। হামলার পরই আবার তারা টানেল নেটওয়ার্কের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেছেন।
ইসরায়েলি সেনারা বলছে তাদের ইয়াহালোম বিশেষ যোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটের সেনারা অন্য শক্তিগুলোর সঙ্গে এসব টানেল চিহ্নিত করে তা ধ্বংস করে দিতে কাজ করছে। একে একজন মুখপাত্র গাজায় জটিল লড়াই হিসেবে অভিহিত করেছে। কয়েক দশকে বেশ কয়েকবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে হামাস। বৈরুতভিত্তিক হামাসের এক্সটার্নাল রিলেশন্স বিভাগের প্রধান আলি বারাকা বলেন, তারা আস্তে আস্তে ক্ষেপণাস্ত্র সহ তাদের সামরিক সক্ষমতা উন্নত করেছেন।
২০০৮ সালে যখন গাজায় যুদ্ধ হয়, তখন হামাস যে রকেট ছুড়েছে তার সর্বোচ্চ পাল্লা ছিল ৪০ কিলোমিটার। কিন্তু ২০২১ সালে এর পাল্লা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৩০ কিলোমিটার। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি যুদ্ধেই নতুন কিছু দিয়ে আমরা ইসরায়েলকে বিস্মিত করে দিচ্ছি।
লেবাননভিত্তিক আরেক যোদ্ধাগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। হামাসের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
তারা বলেছে, কয়েক সপ্তাহ ধরে বোমা হামলা সত্ত্বেও হামাসের যুদ্ধ করার শক্তি অটুট আছে। হামাস ও অন্য আঞ্চলিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে লেবাননে হিজবুল্লার যৌথভাবে একটি সামরিক অপারেশন রুম আছে। হামাস ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন সনদে ইসরায়েলের ধ্বংস আহ্বান করেছে। এ জন্য তাদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের এক সনদে তারা প্রথমবারের মতো ১৯৬৭ সালের সীমান্তের ওপর ভিত্তি করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণাকে মেনে নেয়।
তবে ব্যাপক অর্থে তারা ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। বৈরুতে অবস্থানরত হামাসের কর্মকর্তা ওসামা হামদান বলেন, ৭ই অক্টোবর যে হামলা করা হয়েছে এবং তারপর যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে মানচিত্রে নিয়ে আসার জন্য। এটা তাদের কাছে আমরা বলতে চাই যে, আমাদের নিজেদের গন্তব্য আমাদের নিজেদের হাতে। আমাদের স্বার্থ রক্ষা করে এমন একটি আঞ্চলিক সমীকরণ দাঁড় করাতে চাই।
১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে অসলোতে একটি শান্তিচুক্তি হয় কয়েক দশকের যুদ্ধ বন্ধে। তাতে সুবিধা পায় হামাস। কিন্তু ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এরপর ফিলিস্তিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারীরা বলেন, নেতানিয়াহু সরকার বছরের পর বছর ধরে পশ্চিম তীরে ইহুতি বসতি স্থাপন বন্ধের দাবি প্রত্যাখ্যান করে।
এতে আলাদা একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হয়। অতীতে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা শান্তির পক্ষে বসতি স্থাপন কোনো বাধা নয় বলে উল্লেখ করেন। দখল করে রাখা ভূমি ছেড়ে দেয়ার বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন বর্তমানে উগ্র-ডানপন্থি নেয়ানিয়াহুর জোট সরকার।
২০০২ সাল থেকে আলোচনার টেবিলে আরব শান্তি উদ্যোগ। এতে ব্যাপক আন্তর্জাতিক এবং সর্বসম্মত আরবের সমর্থন আছে। এতে সার্বভৌম একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিনিময়ে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে চুক্তিতে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে ইসরায়েলকে। পক্ষান্তরে আরবের সুন্নিদের সঙ্গে জোট করার অপশন বেছে নিয়েছেন নেতানিয়াহু। এই জোটে আছে মিশর ও জর্ডান। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে ছিল ইসরায়েল।
একই সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মরক্কোর সঙ্গে এমন সম্পর্ক ছিল। ৭ই অক্টোবর হামাসের হামলার আগে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের সঙ্গে ঐতিহাসিক এক কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে অবস্থান নেন। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া এখন স্থগিত হয়ে গেছে।
আপনার মতামত জানানঃ