সমলিঙ্গের বিয়ে নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করলো ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ দশ দিন ধরে এবিষয়ে বিতর্ক শুনেছে। গত ১১মে তাদের রায় ঘোষণা করার কথা ছিল। কিন্তু ওই দিন তারা আরো কিছুদিন সময় চেয়ে নেন। মঙ্গলবার তারা রায় পড়ে শোনান।
প্রসঙ্গত, একটি ঐতিহাসিক রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সমলিঙ্গে বিবাহকে স্বীকৃতি জানালো। চার সদস্যের বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করে। বেঞ্চে ছিলেন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচুর, সঞ্জয় কিষান কোহলি, এস রবীন্দ্রন, হিমা কৌশল ও এস নরসিংহম। প্রধান বিচারপতি তার রায়ে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আইন প্রণয়ন করতে পারে না, আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারে।
তিনি বলেন, সমলিঙ্গে বিয়েকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট-এর প্রয়োজনীয় যে সংশোধন করা দরকার তা সংসদকেই করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পর গে পুরুষদের পুরুষ সঙ্গীকে অথবা লেসবিয়ান নারীর সঙ্গিনীকে বিয়ে করায় আর কোনও বাধা থাকলো না।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় সরকার ৩৭৭ ধারা পরিবর্তন করে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায় মোতাবেক সমকাম কোনও অপরাধ নয় এই ধারাটি সন্নিবেশিত করে। এরপরই সমলিঙ্গে বিবাহের দাবি জোরদার হয়। কেন্দ্রীয় সরকার ও কিছু রাজ্যের আপত্তি ছিল বিষয়টি নিয়ে। সনাতনত্ব এর দ্বারা ক্ষুণ্ন হবে বলে তারা বলেছিলো। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচুর তখন বলেন, সমকাম অপরাধ নয়, অথচ বিয়েতে আপত্তি- এটা দ্বিচারিতার সামিল।
পাঁচ বিচারপতি একটি বিষয়ে সহমত হয়েছেন। ভারতে বিয়ে সংক্রান্ত যে আইন আছে, তা পরিবর্তন করার এক্তিয়ার সুপ্রিম কোর্টের নেই। একমাত্র পার্লামেন্টই সে কাজ করতে পারে। ফলে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে পরিবর্তন ঘটিয়ে সেখানে সমলিঙ্গের বিয়েকে স্বীকৃতি দেয়া সু্প্রিম কোর্টের এক্তিয়ারের মধ্যে নেই বলে জানিয়েছেন তারা। ফলে সমলিঙ্গের বিয়েকে আইনি বৈধতা দেওয়ার যে মামলা হয়েছিল, আদালত সেখানে হস্তক্ষেপ করলো না। পার্লামেন্টই এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। উল্লেখ্য, ভারতে বিয়ে সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি আইন আছে।
এর মধ্যে হিন্দু, ক্রিস্টান, মুসলিম, পার্সি আইন যেমন আছে তেমনই আছে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট। ভিন ধর্মের বিয়ের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য। জাত, ধর্মের ক্ষেত্রে সমানাধিকারের কথা যেখানে বলা হয়েছে। সেই আইনেই পরিবর্তন এনে সমলিঙ্গের বিয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়েছিল এই মামলায়। সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি পার্লামেন্টের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
তবে সমলিঙ্গের সম্পর্কের বৈধতা এবং অধিকার নিয়ে এদিন ঐতিহাসিক মন্তব্য এবং নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। এমনকী, সন্তান দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে যে আইন আছে, সে বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন তিনি। জানিয়েছেন, অবিবাহিত যুগলেরও সন্তান দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে সমান অধিকার আছে।
ফলে সমলিঙ্গের যুগল সন্তান দত্তক নিলে তা অবৈধ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু বেঞ্চের বাকি বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি। পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে তিন বিচারপতি এর বিরোধিতা করেন। বিচারপতি কল প্রধান বিচারপতিকে সমর্থন করেন।
চন্দ্রচূড় জানিয়েছেন, সমলিঙ্গের মানুষ যাতে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, সে দিকে নজর রাখা জরুরি। তার বক্তব্য, বিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কোনো অনঢ় বিষয় নিয়। এর বিবর্তন হয়েছে ঐতিহাসিক সময় ধরেই। ফলে এবিষয়ে আলোচনার সময় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
এর আইনের দিকটি দেখার জন্য একটি কমিটি তৈরির নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই কমিটিতে কাদের রাখতে হবে তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। বস্তুত, এই মামলা লড়ার সময় কেন্দ্রীয় সরকার এই কমিটির প্রস্তাব করেছিল। সরকারের সেই প্রস্তাব মেনে নিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তবে কমিটিতে কারা থাকবেন, তা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
সমলিঙ্গের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাতে কোনো বৈষম্য না হয়, সে বিষয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন বিচারপতি। সেখানে বলা হয়েছে, সমলিঙ্গের কোনো যুগলকে থানায় ডেকে বা বাড়িতে গিয়ে হেনস্থা করতে পারবে না পুলিশ। তাদের লিঙ্গ বিষয়ক কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না।
সমলিঙ্গের যুগল যাতে স্বাধীনভাবে থাকতে পারেন, তাদের বাড়ি পেতে যাতে অসুবিধা না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাষ্ট্র ব্যক্তিকে যে যে অধিকার দেয়, সমলিঙ্গের মানুষদেরও সেই সেই অধিকার প্রাপ্য। এক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। সেই অধিকার রক্ষা করতে হবে রাষ্ট্রকে।
আপনার মতামত জানানঃ