ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেলপথ তৈরিতে ১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রায় ৭৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এ পথটি শতভাগ সরকারি অর্থায়নে নির্মাণ হয়েছে, যার কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের জুনে। ঈশ্বরদী-ঢালারচর রেলপথ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রেলের রাজস্ব আয় বাড়ানো। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসার, রাজধানীর সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপন, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে এবং রিজিওনাল কানেক্টিভিটির নতুন ও বিকল্প রেল রুট স্থাপন। যদিও বিপুল অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে গড়ে তোলা এ রেলপথে বর্তমানে চলাচল করছে দিনে একটি ট্রেন।
ঢালারচর এক্সপ্রেস-৭৭৯ নামের ট্রেনটি সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে ঢালারচর থেকে ছেড়ে বেলা ১১টায় রাজশাহী পৌঁছায়। একই ট্রেন (ঢালারচর এক্সপ্রেস-৭৮০) রাজশাহী থেকে বিকাল সাড়ে ৪টায় ছেড়ে ঢালারচর পৌঁছায় রাত ৮টা ১৫ মিনিটে। ট্রেনটি চলে সপ্তাহে ছয়দিন।
রেলওয়ের তথ্য বলছে, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন লাইন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। শুরুতে রেলপথটির নির্মাণ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৯৮৩ কোটি টাকা। মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১০ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। তবে নির্মাণকাজের দীর্ঘসূত্রতার কারণে একাধিকবার মেয়াদ ও ব্যয় সংশোধন করা হয়। প্রকল্পটি শেষ করতে রেলওয়ের সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৭১৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল বিনিয়োগে গড়ে তোলা এ রেলপথে একটি মাত্র ট্রেন পরিচালনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের বিনিয়োগের সাধারণ উদ্দেশ্য হলো দুটি। প্রথমটি যাত্রীসেবা, দ্বিতীয়টি রাজস্ব আয়। দিনে মাত্র একটি ট্রেন পরিচালনা করে ওই অঞ্চলের যাত্রীসেবা কতটা দেয়া হচ্ছে, যাত্রীদের চাহিদা কতটা পূরণ হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। রেলপথটি নির্মাণের আগে কি যাত্রীদের চাহিদা কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে পর্যালোচনা করেছিল?
‘রেলপথটি নির্মাণে পৌনে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এটা হলো এককালীন বিনিয়োগ। এর বাইরে বর্তমানে স্টেশন পরিচালনা, রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণসহ ট্রেন পরিচালনার আনুষঙ্গিক কাজে রেলওয়েকে কিন্তু প্রতিদিন ব্যয় করতে হচ্ছে। একটি ট্রেন পরিচালনা করা হোক বা একের বেশি—এ পরিচালন ব্যয়ে কিন্তু খুব তারতম্য হওয়ার কথা না। এত বিনিয়োগ করেও একটি মাত্র ট্রেন পরিচালনার কারণে রেলপথটি থেকে তো রাজস্ব আয় হওয়ার কথাও নয়। আমি এক কথায় বলব, এটা হলো রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়’, বললেন বিশেষজ্ঞ এ অধ্যাপক।
ঈশ্বরদী-ঢালারচর রেলপথে ঢালারচর এক্সপ্রেস ট্রেনের চলাচল শুরু হয় ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে। এরপর সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও রুটটিতে নতুন কোনো ট্রেন চালু করতে পারেনি রেলওয়ে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা এজন্য অবশ্য জনবলস্বল্পতাকে দায়ী করেছেন। জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রেলওয়েতে জনবল রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ কারণে আমরা চাইলেও বিভিন্ন রুটে আমাদের পরিচালন কার্যক্রম বাড়াতে পারছি না। তবে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান। প্রয়োজনীয়সংখ্যক জনবল পেলে ঈশ্বরদী-ঢালারচর রুটে নতুন ট্রেন চালু করতে পারব।’
এদিকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ১৬ মে পাবনা সফরে গিয়ে ঢাকা-পাবনা সরাসরি ট্রেন চালুর ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে গত ২৭ সেপ্টেম্বর পাবনা সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, ‘ট্রেন চালুর বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত গেছে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় আছে। তিনি রেল কর্তৃপক্ষকে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করতে বলেছেন। ট্রেন চালু করতে রেলওয়ের লাভ-লোকসানের একটি বিষয় আছে। রেল কর্তৃপক্ষ সেগুলো বিবেচনা করছে।’
রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা-পাবনার মধ্যে সরাসরি ট্রেন চালুর জন্য একটি প্রস্তাব বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পাবনা-ঢালারচর-রাজবাড়ী থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি ট্রেন চালুর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে আগামী নভেম্বরে ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা করছে রেলওয়ে। সংস্থাটির অপারেশন শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা-খুলনা রুটের সুন্দরবন এক্সপ্রেস, ঢাকা-যশোর রুটের বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি পদ্মা সেতু হয়ে চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে সেগুলো ঢাকা থেকে টঙ্গী-জয়দেবপুর-বঙ্গবন্ধু সেতু-ঈশ্বরদী, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়ে চলাচল করছে। পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল শুরু হলে ট্রেন দুটির নতুন রুট হবে কমলাপুর থেকে গেন্ডারিয়া, কেরানীগঞ্জ, সিরাজদীখান, শ্রীনগর, মাওয়া, ভাঙ্গা, রাজবাড়ী হয়ে খুলনা ও যশোর। একইভাবে রাজশাহী থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত চলাচল করা মধুমতী এক্সপ্রেস ট্রেনটি পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা পর্যন্ত চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রেল।
যদিও কবে নাগাদ বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারেননি বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা। তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে অথবা নভেম্বরের শুরুর দিকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হতে পারে। তবে ঢাকা-পাবনা সরাসরি ট্রেন চালুর পরিকল্পনা আপাতত নেই বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
আপনার মতামত জানানঃ