গাজায় যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিশোধ নেয়ার প্রত্যয়ে ভয়াবহ হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। শনিবার হামাসের আকস্মিক কয়েক হাজার রকেট হামলায় ইসরায়েলে কমপক্ষে ৩০০ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে খবর দিয়েছে অনলাইন টাইমস অব ইসরায়েল। বিভিন্ন শহরে ভয়াবহ সেই হামলার প্রতিশোধ নিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
শনিবারই ইসরায়েলের বিমানবাহিনী আকাশপথে হামাসের লক্ষ্যবস্তু টার্গেট করে বোমা হামলা চালিয়েছে। স্থল অভিযানেরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় গাজায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৩০ ফিলিস্তিনি। আগতদেরকে নিয়ে গাজায় আল শিফা হাসপাতালে দৌড়াতে দেখা গেছে আত্মীয়স্বজনদের। আল জাজিরা বলছে, ইসরায়েলে হামাস যে সহিংস হামলা চালিয়েছে তাতে ৫০ বছর আগের ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক সহ মুসলিম দেশগুলো।
অন্যদিকে ইসরায়েলে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন, ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শুলটজ, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুথ প্রমুখ। শনিবারই এই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তাদেরকে তিনি জানিয়েছেন, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে।
হামাসের হামলাকে তিনি সন্ত্রাসী হামলা বলে অভিহিত করেন। ওদিকে সৌদি আরব বলেছে, তারা অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে ঘনিষ্ঠভাবে দৃষ্টি রাখছে।
উভয় পক্ষকে উত্তেজনা বন্ধ করার অনুরোধ করা হয় তাৎক্ষণিকভাবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলেছে, অব্যাহত দখলদারিত্ব এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখায় বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে আগে অনেকবার সতর্ক করা হয়েছে। মাঝে মাঝেই দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করে মিশর। তারা রক্তপাত বন্ধে উপায় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে এরই মধ্যে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরি বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে জোরালো যোগাযোগ শুরু করেছেন। রাজনৈতিক এক কনফারেন্সে বক্তব্যকালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান বলেছেন, তার দেশ এ অবস্থায় সব পক্ষের প্রতি বিরত থাকার আহ্বান জানায়।
‘ফিলিস্তিনিদের মুক্ত করতে যথেষ্ট ইসরায়েলি হামাসের হাতে আটক আছে’
এমনকি ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্ত করার জন্য হামাসের কাছে যথেষ্ট ইসরায়েলি বন্দি আটক রয়েছে বলেও জানিয়েছে তারা। শনিবার রাতে এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
হামাসের একজন সিনিয়র নেতা বলেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন হামলার সময় বহু ইসরায়েলি সৈন্যকে আটক করেছে তারা। আর সেটি ইসরায়েলি কারাগারে থাকা সব ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্ত করার জন্য যথেষ্ট।
হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর ডেপুটি চিফ সালেহ আল-আরৌরি শনিবার আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘আমরা অনেক ইসরায়েলি সৈন্যকে হত্যা ও বন্দি করতে পেরেছি। লড়াই এখনও চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের কারাগারে আটক থাকা আমাদের বন্দিদের মুক্ত হওয়ার সময় এগিয়ে আসছে। আমাদের হাতে যা আছে তার মাধ্যমে আমাদের সকল বন্দিকে তারা মুক্তি দেবে। লড়াই যত দীর্ঘ হবে, বন্দিদের সংখ্যাও তত বেশি হবে।’
আল-আরৌরি বলেছেন, হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি বন্দিদের মধ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর সিনিয়র অফিসাররাও রয়েছেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা ঠিক কত তা সম্পর্কে কোনও পরিসংখ্যান তিনি দেননি।
অবশ্য বন্দিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা এনজিও অ্যাডামিরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রায় ৫ হাজার ২০০ জন ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের কারাগারে বর্তমানে বন্দি রয়েছে। যার মধ্যে ৩৩ জন নারী, ১৭০ জন নাবালক। এছাড়া ১২০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে প্রশাসনিকভাবে বন্দি রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীও স্বীকার করেছে যে, হামাসের হামলায় তাদের সৈন্য ও কমান্ডাররা নিহত হয়েছে এবং অনেককে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে ঠিক কতজন সেনা নিহত হয়েছে বা হামাস কতজনকে বন্দি করে নিয়ে গেছে তার কোনও পরিসংখ্যান দেয়নি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
হামাসের হামলার কারণ
ইসরায়েলে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ যুদ্ধ একদিনের কথা নয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের তিনবার যুদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৪৮ সালে একবার, ১৯৬৫ সালের ছয়দিনের যুদ্ধ এবং সর্বশেষ ১৯৭৩ সালে সিনাই উপত্যকা ও গোলান মালভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধ করে সিরিয়া-মিশর জোট।
এরপর থেকে ইসরায়েলের হামলার জবাব দিয়ে আসছিল ফিলিস্তিনের সশস্ত্র যোদ্ধারা। কিন্তু ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের ৫০ বছরে হামাসের হামলা নতুন করে হিসাবনিকাশে বাধ্য করছে ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপ হয়েছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর। বাইডেন সেই ফোনালাপে হামাসের হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) এর নিন্দা জানায়।
ইসরায়েলে এ হামলায় সর্বশেষ ২৯৮ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এর মধ্যে ফিলিস্তিনি রয়েছেন ১৯৮ জন ও ইসরায়েলি রয়েছেন ১০০ জন।
দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ডেভিড হোরোভিটজ এক বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধে হামাস ইসরায়েলের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘একটা বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেওয়া দরকার। হামাসের এই হামলা ৫০ বছরের আগের একটি ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মিশর ও সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট অভিযান চালায় ইসরায়েলে। সেই সংঘাত ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, অক্টোবর যুদ্ধ, রমজান যুদ্ধ, ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছিল।
১৯৭৩ সালের ৬-২৫ অক্টোবরের মধ্যে সংঘটিত আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ফলে উভয়পক্ষের সম্পর্ক কতটা তিক্ত হয়ে ওঠে, পেছনে ফিরে তাকালেই তার বহু প্রমাণ মিলবে। এই অর্থে বলতে হয়, অর্ধশতাব্দী পর আবারও ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ‘নতুন অভিযান’ চালানোর মধ্য দিয়ে বিশ্ব নতুন করে কী দেখবে, সেটাই চিন্তার বিষয়!’
অর্ধশতাব্দী পর হামাসের এ হামলা ইসরায়েলিদের উদ্দেশে বিশেষ বার্তা বহন করে বলেই অভিমত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন প্রতিরোধ করার জন্য আকস্মিক এ হামলা করা হলো। অপরদিকে হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এই যুদ্ধে যদি কারও একটি বন্দুকও থাকে, তবে তাই নিয়ে ইসরায়েলি হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত।’
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হামাসের মুখপাত্র খালেদ কাদোমি বলেন, ‘দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো নৃশংসতার জবাবে এই সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে। আমরা চাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজায়, ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর এবং আমাদের পবিত্র স্থাপনা আল-আকসায় ইসরায়েলি নৃশংসতা বন্ধে উদ্যোগ নেবে। এগুলোই হামাসের এই অভিযানের কারণ।’
এছাড়া এ হামলার মধ্য দিয়ে আরব বিশ্বকেও বার্তা দিয়েছে হামাস। বিশেষ করে যেসব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে, তাদের প্রতি বিশেষ বার্তা এটি। টেলিগ্রামে এক পোস্টে পশ্চিম তীরের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে এই যুদ্ধে আরব ও মুসলিম বিশ্বকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে হামাস।
গাজায় হামাস সরকারের সাবেক উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজি হামাদ বলেন, ‘যেসব আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে, এই অভিযান তাদের জন্যও একধরনের বার্তা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা তাদের জন্য লজ্জার। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে আরব দেশগুলোর প্রতি আমি আহ্বান জানাই। কারণ ইসরায়েল শান্তি ও সহাবস্থানে বিশ্বাস করে, এমন কোনো দেশ নয়। এটা শত্রু রাষ্ট্র; তাদের প্রতিহত করতে হবে।’
আপনার মতামত জানানঃ