: আলী বাবার কো ফাউন্ডার জ্যাক মা দুই মাস যাবত নিরুদ্দেশ। তার স্যোশাল মিডিয়া একাউন্ট ইনএ্যাকটিভ অবস্থায় রয়েছে গত বছরের অক্টোবর থেকে। গত বছরের নভেম্বরে কিছু সামাজিক অনুষ্ঠানে তার উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল, সেগুলোতেও তাকে দেখা যায়নি। একই সাথে চীনা সরকারের দ্বারা তার ও তার কোম্পানির বিরুদ্ধে কিছু ইনভেস্টিগেশনের সংবাদ সাম্প্রতিক সামনে এসেছে, সেগুলো নিয়েও বহু আলোচনা-সমালোচনা চলছে। উল্লেখ্য জ্যাক মা প্রথম বিলিয়নেয়ার নন যিনি চীন সরকারের রোষানলে পড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। যদিও চীন সরকারের পক্ষ থেকে বা অন্য কোন মাধ্যমের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি যে চীন সরকারই জ্যাক মা’কে গুম করেছে কিন্তু কিছু বিষয় পর্যালোচনা করলে এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। চীন এমনটা পূর্বেও বহুবার করেছে, চীনের বড় বড় বিজনেস টাইকুন শিকার হয়েছে সরকারের রোষানলের।
জ্যাক মা একজন চীনা বিজনেস ম্যাগনেট, ইনভেস্টর এবং ফিলান্থ্রোপিস্ট। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রিটেইলার মাল্টিন্যাশনাল টেকনোলজি কনগ্লোমেরেট ই-কমার্স ও ইন্টারনেট কোম্পানি আলীবাবার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান ছাড়াও বড় দানবীর হিসেবে তিনি বিপুল জনপ্রিয়। করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে আঘাত হানলে বিপুল পরিমাণে টেস্টিং কিট উপহার হিসেবে প্রদান করেন তিনি এটা নিশ্চয় ভুলে যায়নি এ দেশের জনগণ। জুলাই ২০২০ পর্যন্ত জ্যাক মা’র সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪৮.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি ছিলেন চীনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি এবং পৃথিবীব্যপী সেরা ২০ জন সম্পদশালী ব্যক্তির একজন। শুরু থেকেই তিনি ছিলেন ওপেন এন্ড মার্কেট-ড্রিভেন ইকোনমির শক্তিশালী প্রবক্তা ছিলেন। মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবক্তা ছিলেন ঠিকই কিন্তু তার নিজ দেশে চীন কঠোর সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে। তাদের মার্কেট-ড্রিভেন খুবই কম। মার্কেটের উপর তাদের সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুবই বেশি। কিন্তু মা প্রথম থেকেই চাইতেন অর্থনীতি সব সময় মার্কেট ড্রিভেন হতে হবে, চাহিদা অনুযায়ী যোগান নিশ্চিত করতে হবে, মার্কেটের উপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে।
২০২০ এর অক্টোবর থেকে জ্যাক মা আলোচনায় চলে আসেন। মার্কেট নিয়ে তার যে ব্যক্তিগত মতাদর্শ তা বারবার সংবাদে আসতে থাকে। অক্টোবর ২৬ তারিখ চাইনা ব্রেকিং নিউজ পোর্টালের সংবাদে প্রকাশ করা হয়। এর দুই দিন পূর্বে তিনি বেশ দীর্ঘ একটি স্পিচ প্রদান করেন। দুই দিন পর সেই স্পিচ সংবাদ মাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করতে থাকে। সেই বক্তৃতায় চীনের ট্রেডিশনাল ব্যাংকিং সিস্টেমের প্রচণ্ড সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, যে পদ্ধতিতে চীন কাজ করে সেই পদ্ধতির কারণে চীনকে এখনও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বলে বিবেচনা করা হয়। চীনের ট্রেডিশনাল ব্যাংকিং মেন্টালিটি হ’ল ‘পওনশপ মেন্টালিটি।’ তাদের ব্যুরোক্রেসি সিস্টেমের কারণে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও ইনোভেশন হয় না। এবং ব্যাংকিং এর উপরে যে নীতিমালা আরোপ করা হয় তা ‘বুড়োদের আখড়া’ ছাড়া কিছুই না। তিনি চীন সরকারের মূলনীতিকে সেই বক্তৃতায় তুলোধুনো করেন। তিনি আরও বলেন, আমরা এই সিস্টেমকে বদলাতে পারব যদি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অথবা বিগ ডেটা-বেজড ক্রেডিট সিস্টেম ব্যাবহার করি।
তার সমালোচনাগুলো চাইনিজ অথোরিটি বিশেষ করে চীনের প্রেসিডেন্ট ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেননি। এর পরপরই চীন তথা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ আইপিও আসার কথা ছিল, সেটা রদ করা হয়। এটি বাজারে নিয়ে আসার কথা ছিল অ্যান্ট গ্রুপ। বলা হচ্ছিল এটি যখন বাজারে আসবে তখন তা বিশাল বড় ইতিহাস রচনা রচনা করবে। কিন্তু জ্যাক মা’র ২৪ অক্টোবরের বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে এটিকে বাজারে নামতে বাঁধা দেওয়া হয়। কেননা এর সম্পূর্ণ হেডিং ক্রেডিট ছিল জ্যাক মা’র। আইপিও লিস্ট হওয়ার মাত্র দুই দিন পূর্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এটি সাসপেন্ড করে দেয়। চীনা সরকার স্পষ্টরূপে সংকেত প্রদান করে যে, সরকারের সমালোচনা করে এখানে টিকে থাকতে পারবে না। সে সময় ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল একটি রিপোর্ট প্রদান করে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং এর সিদ্ধান্তে এ্যান্টের আইপিও হল্ট করা হয়। এ্যান্টগ্রুপ হ’ল ফিনটেক সেক্টরের একটি প্রতিষ্ঠান। ফিনটেক অর্থাৎ ফাইনান্স টেকনোলজি। এখানে ফাইন্যান্সকে টেকনোলজির সাথে মিলিয়ে ব্যাংকিং এর নীতিমালা সাজানো হয়। এর মূল্য ছিল প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার। পুরো অর্থটা এক কথায় জলে ভেসে যায়। এটি লঞ্চ হলে বিশ্ব শেয়ার বাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আইপিও হতে পারত।
এই ঘটনার পর মাত্র ১১ দিন পূর্বে অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর, জ্যাক মা’কে টার্গেট করে এ্যান্টি-মনোপলি ইনভেস্টিগেশন শুরু করা হয়। তাদের দাবী ছিল আলীবাবা পুরো বাজারব্যবস্থাকে মনোপলাইজ ও দখলের চেষ্টা করছে। ইনভেস্টিগেশনের খবর প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলীবাবা গ্রুপের শেয়ারের মূল্য নিচে নেমে যায়। ২৮ শে ডিসেম্বর চীন সরকার হুকুম দেয় জ্যাক মা যেন তার ফিনটেক এম্পায়ার ছোট করে ফেলে। সেন্ট্রাল ব্যাংক এটিকে ‘অবৈধ কর্মকাণ্ড’ বলে রায় দেয়।
এসব ঘটনা যখন ঘটে চলেছিল তখনও বড় একটি ব্রেকিং নিউজ বাকী ছিল। গতকাল দুপুরে ইয়াহু ফাইনান্সের মতন শক্তিশালী কিছু সংবাদ মাধ্যমের বরাত দিয়ে জানানো হয়, আলীবাবার সহ প্রতিষ্ঠাতা নিরুদ্দেশ। তাদের দাবী গত দুই মাস যাবত জ্যাক মা শারীরিক অথবা ভার্চুয়াল উপস্থিতি দেখা যায়নি। তাই ধারণা করা হচ্ছে, খুব সম্ভবত চীন সরকার তাকে গুম করেছে। টুইটারে তার সর্ব শেষ টুইট ছিল অক্টোবরের ১০ তারিখ। এরপর টুইটারে তার কোন এক্টিভিটি নজরে পড়েনি। জ্যাক মা’র দ্বারা পরিচালিত বিপুল জনপ্রিয় টিভি রিয়ালিটি শো ‘আফ্রিকা’স বিজনেস হিরোস’ এর গ্রান্ড ফিনালের এপিসোডে উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও তাকে সেখানে দেখা যায়নি। এ সমস্ত কারণে কিছু গবেষক ও উদ্যোক্তা বিনিয়োগকারীদের ধারণা তিনি নিরুদ্দেশ।
অপরদিকে চীন সরকারের দ্বারা ফিনটেক জায়ান্টদের অপহরণের ঘটনা এটিই প্রথম না। আলীবাবার প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি টেনসেন্ট হোল্ডিংস তাদের উপরেও প্রচুর চাপ প্রয়োগ করা হয় যেন তারা কাস্টমারের সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে আসে। সমস্যা হ’ল এই দুই কোম্পানি তাদের কাস্টমার সংখ্যা কমিয়ে দিলে চীনের মোট ব্যাংক হিসাবের সংখ্যাও কমতে থাকে। ফলে তাদের উপরে অতিরিক্ত চাপ থাকে যেন ব্যাংক হিসাব সংখ্যা না কমিয়ে তারা তাদের কাস্টমার সংখ্যা সীমিত করে।
চীনে যখনই ফিনটেকে কেউ জায়ান্ট হয়েছে তাকেই কোন না কোন ভাবে জনবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের জুলাই ২০২০ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, জাও জিয়ানহুয়াকে তিন বছর আগে গুম করে চীন সরকার। তিনিও ফিনটেক সেক্টর নিয়ে কাজ করছিলেন, তার কাজের পদ্ধতি তাকে সে সময় বেশ জনপ্রিয়ও করে তোলে। তার থ্রিহুইলিং ফিন্যান্স সিস্টেম চীনের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে টার্গেট করে আমূলে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে ২০১৮ থেকে তার কোন খোঁজ কেউ দিতে পারেনি।
২০২০ এর সেপ্টেম্বরে আরেকটি নাম সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এসেছিল। রেন জিকিয়াং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে করোনা ভাইরাস আউটব্রেকের জন্য শী জিনপিনের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি রিয়েলস্টেট টাইকুন ছিলেন, কিন্তু সরকারের সমালোচনা করার জন্য তাকে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অতএব দেখা যাচ্ছে, চীনের গল্প এখনও তেমনই আছে যেমনটা আগেও ছিল। এবার হয়তো শিকার হয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত একজন বিজনেস ম্যাগনেট জ্যাক মা, কিন্তু ভুক্তভোগী আমরা সবাই।
আপনার মতামত জানানঃ