ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী মঞ্জুরুল ইসলাম। গোপালগঞ্জ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসা। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ঠাঁই হয় মঞ্জুরুলের। ওই রুমে আট শিক্ষার্থীর বাস। ২১শে আগস্ট বিকালে রুমের অন্যরা যখন বাইরে তখন মঞ্জুরুল সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দেন। পরে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান রুমমেটরা। মঞ্জুরুলের রুমমেটরা জানায়, মঞ্জুরুল কিছুদিন ধরে অর্থনৈতিক সমস্যা ও হতাশায় ভুগছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনে ভিন্ন ভিন্ন কারণ থাকে। যারা আত্মহত্যা করছেন অধিকাংশই কোনো না কোনো কারণে পড়াশোনা, কর্মজীবন, আর্থিক সমস্যা, অভাব-অনটন, পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে সংশয় এবং ভয়ের মধ্যে থাকে।
শুধু মঞ্জুরুল নয়, প্রতিদিনই কোনো না কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। দিশাহারা হয়ে পড়ে তাদের পরিবার। এ সকল সন্তানদের কেউ কেউ বেড়ে উঠে অবহেলা ও অনাদরে।
শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতা, পারিবারিক কলহ এবং সম্পর্কের বিচ্ছেদ, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, মাদকের ব্যবহার, অর্থনৈতিক সমস্যা, পড়াশোনার চাপ, বেকারত্ব, পারিবারিক আত্মহত্যার ইতিহাস, বিভিন্ন সামাজিক চাপ, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষার মধ্যে পার্থক্য, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীনতা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটটি থেকে আত্মহত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাপত্রের তথ্য ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৩২ জন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। ২০১৬ সালে দেশে ৯ হাজারেরও কম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ১০ হাজার ও ১১ হাজারের বেশি ছিল। ২০২২ সালে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা জানান, ময়নাতদন্তের জন্য আসা বেশির ভাগই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটায় গলায় ফাঁস দিয়ে। আর কিছু কিছু মৃত্যু হয় বিষ পানে এবং তাদের বয়স থাকে ১৮ থেকে শুরু করে ৫০ বছর পর্যন্ত। সাধারণত দুইভাবে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে, আবেগ প্রবণ হয়ে এবং পরিকল্পনা করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। দিন প্রতি ২ হাজার ১৯১ জন। প্রতি লাখে প্রায় ১৬ জন এবং প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন। ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন (আইএএসপি) এর এক তথ্যগ্রাফিতে তুলে ধরা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার হার নারীদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি এবং মোট আত্মহত্যাকারীদের অর্ধেকেরও বেশি (৫৮ শতাংশ) ৫০ বছর বয়সের আগে আত্মহত্যা করে থাকে। আত্মহত্যার প্রবণতার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম স্থানে রয়েছে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৮ মাসে ৩৬১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ১৬৯ জন স্কুল শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননের হার ক্রমবর্ধমান। গত আট মাসে ১৬৯ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৯৬ জন কলেজ শিক্ষার্থী, ৬৬ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং ৩০ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
২০২২ সালের একই সময়ে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৯.৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী গত আট মাসে আত্মহত্যা করেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ৪৬.৮ শতাংশই স্কুল শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থী ১১২ জন আর ছেলে ৫৭ জন। এ ছাড়া আত্মহননকারীদের মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ৮ দশমিক ৩১ শতাংশ। আত্মহত্যাকারীদের বয়সভিত্তিক বিবেচনায় দেখা যায় সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা।
১ থেকে ১২ বছরের শিক্ষার্থী ছিল ৮.৩০ শতাংশ। অভিমানের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ৩১ দশমিক ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ৫৭ জন এবং সমসংখ্যক পুরুষ শিক্ষার্থী রয়েছেন। গত ৮ মাসে সবচেয়ে বেশি অত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে আত্মহত্যা করেছে ৩১.৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ (১৪.১০ শতাংশ), খুলনা বিভাগ (১৩ শতাংশ), রাজশাহী (১১.৯০ শতাংশ) ময়মনসিংহ (১০ শতাংশ) রংপুর (৮.৯০ শতাংশ), বরিশাল (৮.৩০ শতাংশ) ও সিলেট বিভাগে ২.৫ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, মানুষ যেসব কারণে আত্মহত্যা করছে সেটি আমাদের ভাষায় সিমট্রমসে সে আত্মহত্যা করছে। কোনো কারণে তারমধ্যে কিছু সিমট্রম গ্রো করেছে সে আসলে সেই সিমট্রমকে নিতে পারেনি। এর পেছনের কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটা হচ্ছে মিলেমিশে একসঙ্গে বসবাস করা।
কিন্তু আমরা যখন দেখছি এই সমস্ত মানুষগুলো যখন দেখছে সে যখন বিপদে পড়ছে তার পাশে কাউকে পাচ্ছে না বরং তাকে সহযোগিতা বা অনুপ্রেরণা দেয়ার পরিবর্তে তার ওই সমস্যাটা নিয়ে কেউ মশকারা করছে অথবা তাকে কলঙ্কিত বা অবহেলা করছে এবং এড়িয়ে যাচ্ছে তখন কিন্তু সে চলমান ঘটনার সঙ্গে মিল খুঁজে পায় না। কোনো ব্যক্তির পক্ষে এই ধরনের পরিবার বা সম্পর্ক ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায় অন্যের সহযোগিতা ছাড়া অধিকাংশ সমস্যা মোকাবিলা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আসলে চারপাশের সহযোগিতা, সহমর্মিতা এই সংস্কৃতিটা বেশি প্রয়োজন আমাদের সমাজ কাঠামোর জন্য।
তিনি বলেন, অত্মকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য যখন তৈরি হয় সবাই যার যার মতো করে ভালো থাকার চেষ্টা করে। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা থাকা উচিত যাতে মানুষ সমানতালে চলতে পারে। অন্যথায় তার বৈষম্য তৈরি হবে, বৈষম্য দ্বারা সে প্রভাবিত হবে এবং এই বৈষম্য দ্বারা সে বঞ্চিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যখন কোনো ব্যক্তি বঞ্চিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তখনই সে কোনো ঘটনা ঘটায়। আমরা একটা সময় দেখতাম একেবারে প্রান্তিক মানুষ, অল্প শিক্ষিত, অসচেতন ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলোর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি ছিল।
এখন কিন্তু অনেকটা বিপরীত হয়েছে উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ও সচেতন মানুষরাই আত্মহত্যা বেশি করছে। চাকরি বা ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা অথবা বিভিন্ন সংকট তৈরি হয় তাদের মধ্যে। আমরা যে একাডেমিক কারিকুলামকে ডেভেলপ করছি সেখানে আসলে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট একজন ব্যক্তির জীবনে অথবা কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট যেকোনো সিচুয়েশন ম্যানেজমেন্টের শিক্ষাগুলো দিতে পারছি না। রাষ্ট্রের একজন নাগরিককে সকল ধরনের অবস্থাকে মোকাবিলা করে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন করা। এবং সব পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে চলার জন্য সক্ষমতা তৈরি করা দরকার।
আপনার মতামত জানানঃ