বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চলমান বকেয়া পরিশোধে প্রতি মাসে ৯৬ কোটি ডলার ছাড় করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত জুলাইয়ে দেয়া ওই নির্দেশনায় বিদ্যুৎ খাতের জন্য প্রতি সপ্তাহে ১৬ কোটি ডলার এবং জ্বালানি খাতের জন্য সপ্তাহে ৮ কোটি ডলার ছাড়ের নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার দুই মাস অতিবাহিত হলেও এখনো বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা আরো বেড়েছে। বছর শেষে বকেয়ার পরিমাণ আরো বেড়ে গেলে দেশে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানিতে বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা দেখছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বকেয়া ছাড়াও শুধু বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় রাখতে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জ্বালানি খাতে ৬ বিলিয়ন (৫৯২ কোটি) ডলারের কাছাকাছি অর্থ প্রয়োজন হবে বলে জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্ট এক সূত্রের তথ্যে উঠে এসেছে। এর মধ্যে বকেয়ার অর্থ পরিশোধ না হলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বড় ধরনের বিপত্তির আশঙ্কা রয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এ দুই খাতে বকেয়ার পরিমাণ ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন (৩৩০ কোটি) ডলার। সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী টাকার হিসাবে এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশিতে। বিপুল পরিমাণ এ বকেয়ার মধ্যে শুধু বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোই (আইপিপি) পাবে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়া রয়েছে পাঁচ মাসের, যার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।
ভারতের আদানি পাওয়ারের কাছে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) পাবে ৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া পেট্রোবাংলার কাছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহকারী বিদেশী কোম্পানিগুলো পাবে ৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী ছয়টি প্রতিষ্ঠানের পাওনা আটকা রয়েছে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্থছাড়ের বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক দফায় দফায় বৈঠক করলেও প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হচ্ছে না। ফলে অর্থছাড় হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে বিদ্যমান অর্থছাড় বা ডলার ছাড় করে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালানো গেলেও বকেয়া পরিশোধের বিষয়টি সুরাহা হচ্ছে না।
এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) দেনা সবচেয়ে বেশি। আগস্ট পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী আইপিপিগুলো সংস্থাটির কাছে পাবে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। এ বিল সরকার পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বকেয়া পরিশোধে বিদ্যুৎ বিভাগের তৎপরতার বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান এবং বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুতের বকেয়া বিলের পরিমাণ এখন অনেক। ডলার সংকটের কারণে এ জটিলতা তৈরি হয়েছে। সরকারপ্রধান একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। সেটি বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। হচ্ছে না এমনটি নয়। এ পরিস্থিতি বেসরকারি বিদ্যুৎ উদ্যোক্তারাও মানছেন। তবে যত দ্রুত সম্ভব এটির একটি সমাধানে আসবে বিদ্যুৎ বিভাগ।’
বিদেশী এলএনজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, দেশে গ্যাস উত্তোলনকারী বিদেশী কোম্পানি (আইওসি) এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া পরিশোধে গত জুলাইয়ে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার ভিত্তিতে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৯৬ কোটি ডলার পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে আইপিপিগুলোর বকেয়া পরিশোধের জন্য প্রতি সপ্তাহে বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য ১৬ কোটি ডলার ব্যয় এবং জ্বালানি বিভাগের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহকারীদের অর্থ পরিশোধের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৮ কোটি ডলার ছাড়ের নির্দেশনা দেয়া হয়। এ নির্দেশনা জুলাই থেকে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। যদিও এরপর গত দুই মাসে বকেয়ার পরিমাণ পর্যায়ক্রমে আরো বেড়েছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়া পরিশোধে সরকারের নেয়া উদ্যোগের বাস্তবায়ন যথাযথ হচ্ছে না বলে মনে করেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধে বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
এ বিষয়ে কনফিডেন্স পাওয়ার হোল্ডিংস লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বকেয়া বিল পরিশোধের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী যেটা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তবে চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। তবে বকেয়া বিলের বিষয়ে দ্রুত সুরাহা হবে এমনটি আশা করা কঠিন। এটার সমাধান করতে হলে আর্থিক সিদ্ধান্তটা নিতে হবে।’
বকেয়া পরিশোধের বিষয়টির তেমন কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো এখন কার্যক্রম চালাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। অন্যদিকে বকেয়া পরিশোধের বিষয়টির সুরাহা না হলে সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বিআইপিপিএর সভাপতি এবং সামিট গ্রুপের পরিচালক ফয়সাল করিম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়া পরিশোধে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। আর্থিক সংকটে আইপিপিগুলো ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। দেরিতে বিল পরিশোধ ও বিল আটকে থাকায় অনেক আইপিপিকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিতে হচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে সময়মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না। আমরা দ্রুত ডলার সংকটের বিষয়টির সমাধান চাই।’
জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত দীর্ঘদিন ধরে লোকসানের চক্রে পড়েছে। এ খাতে একের পর এক অবকাঠামো তৈরি করে তার ব্যবহার করা যায়নি। ফলে অর্থনৈতিক সফলতা না মেলায় আর্থিক দেনা তৈরি হয়েছে। এ দেনা এখন বড় বোঝা তৈরি করেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি যে হবে তা সহজেই অনুমেয় ছিল। কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে সফলতা পাওয়া যাবে কিনা তার বিশ্লেষণ হয়নি। আমদানি বাড়ানো হয়েছে। একটা পর্যায়ে তো থামতে হবে। এখন এ দেনা বাড়ার বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে। এখান থেকে শিগগিরই বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই।’
দেশের বিদ্যুতের একক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিপিডিবি। বকেয়া বিল পরিশোধে সংস্থাটিও এখনো বিদ্যুৎ বিভাগের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এছাড়া অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেও কোনো অগ্রগতি দেখছেন না বলে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
বিপিডিবির নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, ‘অর্থছাড়ের বিষয়ে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেটি খুব বেশি কাজে আসছে না। অর্থ বিভাগ প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে পারছে না। যে কারণে বিপিডিবিও তার বেসরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিল পরিশোধ করতে পারছে না। আদতে এ অর্থ পরিশোধের বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিদ্ধান্ত ছাড়া বিপিডিবির আলাদা করে কোনো পরিকল্পনা নেই।’
এসডব্লিউএসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ