ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে ৫১৪ জন মারা গেলেন। আর চলতি মাসে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২৬৩ জনের।
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (গত বুধবার সকাল আটটা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল আটটা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৬ জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ২ জন মারা গেছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে ২ হাজার ২০১ জন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৯২৬ এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ১ হাজার ২৭৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৮ হাজার ৬৩০ জন। তাঁদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৫১ হাজার ৯৫৩ ও ঢাকার বাইরে ৫৬ হাজার ৬৭৭ জন।
ডেঙ্গুতে শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে এ পর্যন্ত ২০ হাজার ৮৫১ শিশু ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। যা মোট আক্রান্তের প্রায় ২০ শতাংশ। আর প্রাণহানি ঘটেছে ৬৪ জনের। আক্রান্তের পাশাপাশি ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু। শিশুদের ডেঙ্গু চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশুরা চিকিৎসার আওতায় আসছে দেরিতে। স্বাভাবিক জ্বর মনে করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেরিতে করা হচ্ছে। শেষ সময়ে হাসপাতালে আনার কারণে অনেকে মারা যাচ্ছে।
দেশের ৬৪ জেলাতেই ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে লাখ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, পূর্বের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা কমেছে। কিন্তু ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এরই মধ্যে প্রাণহানি ৫০০ ছাড়িয়েছে। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে সংখ্যা, তা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এবছরের ডেঙ্গু রোগীর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১লা জানুয়ারি থেকে ২৩শে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার ৪২৯ জন। এরমধ্যে শূন্য থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২০ হাজার ৮৫১ জন শিশু। যা মোট শনাক্তের ১৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এই বযসসীমায় মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা ৬৪ জন। যা মোট মৃত্যুর ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
শিশু আক্রান্তদের মধ্যে রাজধানীতে ১২ হাজার ৮৮১ জন এবং ঢাকার বাইরে ৭ হাজার ৯৭০ জন। বয়স অনুসারে শূন্য থেকে ৫ বছরের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি সংখ্যা ৬ হাজার ৩১০ জন। এরমধ্যে কন্যা শিশু ২ হাজার ৬৮৮ জন এবং ছেলে শিশু ৩ হাজার ২২২ জন। এই বয়সসীমায় মারা গেছে ২০ জন।
৬ থেকে ১০ বছরের শিশু আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৪৪২ জন। এরমধ্যে কন্যা শিশু ২ হাজার ৭৩২ জন এবং ছেলে শিশু ৩ হাজার ৭১০ জন। এই বয়সসীমায় প্রাণহানি হয়েছে ২৫ জনের। ১১ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৮ হাজার ৯৯ জন। এরমধ্যে মেয়ে শিশু ২ হাজার ৭৯৭ জন এবং ছেলে শিশু ৫ হাজার ৩০৩ জন। এই বয়সসীমায় মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা ১৯ জন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, রাতে তো বটেই, দিনের বেলা যেকোনো সময় ঘুমালে শিশুকে অবশ্যই মশারির ভেতর রাখতে হবে। অন্যান্য সময় শরীর খালি অংশ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। সাদা বা কম উজ্জ্বল কাপড়ের প্রতি মশা আকৃষ্ট হয় কম। তাই বাচ্চাদের উজ্জ্বল রঙের কাপড় কম পরানো উচিত।
শিশুর মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শিশুরা ডেঙ্গু রোগের লক্ষণগুলো বুঝতে বা বলতে পারে না। শরীরে রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত কমতে শুরু করে। হঠাৎ করে ডেঙ্গুর শকে চলে যায়। যদি প্রথমদিকে ডেঙ্গু শনাক্ত করা যায় তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের সমস্যা হয় না।
কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ চিকিৎসার আওতায় আসতে দেরি হলে শিশুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখন অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। ওই সময় জরুরি চিকিৎসা করলেও বাঁচানোটা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।
খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, বাচ্চারা দিনে বা রাতে যখনই ঘুমাবে, অবশ্যই মশারি টাঙাতে হবে। বাচ্চারা ঘুমানোর সময় যাতে শরীরের কোনো অংশ খালি না থাকে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। নিজের বাড়িঘর পরিষ্কার রাখতে হবে। যাদের চলাফেরা কম, তাদের মশায় কামড়ানোর হার অনেক বেশি।
বিশেষ করে যেসব শিশু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে বা দিনের বেলায়ও ঘুমায়, তাদের মশারির নিচে থাকার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আর বড় কিংবা ছোট যেকোনো বয়সের মানুষের জ্বর দেখা দিলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দেন তিনি।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই বছর বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তি হয়েছে, যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ভর্তি হওয়া রোগীদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু। হাসপাতালটির এক শিশু চিকিৎসক বলেন, একাধিক রোগী এক বিছানায় চিকিৎসা নিচ্ছে আবার কেউ ফ্লোরে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে।
এক বছরের কম বয়সী শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে আছে। জ্বর থাকলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করা উচিত; এটাকে ভাইরাল জ্বর বলে অবহেলা করা উচিত নয়। জ্বর চলে গেলে ভয় শুরু হয়, তখন আপনাকে আরও সতর্ক হতে হবে। ছোট শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা করা কঠিন। কারণ তাদের রক্তচাপ সঠিকভাবে মাপা যায় না। শিশুদের দেহে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টও চ্যালেঞ্জিং। শিশুরা তাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারে না এবং যে কোনো সময় শকে চলে যেতে পারে। এজন্য শিশুদের ব্যাপারে আরও সতর্ক থাকতে হবে।
কীটতত্ত্ববিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, শিশুদের আক্রান্তের সঠিক কারণ জানতে পারলে এর প্রতিকার করা সম্ভব। কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘ গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি শিশুদের মশা কামড়ানোর ঝুঁকি বেশি। স্ত্রী মশার পেটে যখন ডিম আসে তখন তার প্রধান খাদ্য রক্ত এবং শিশুরা প্রায়শই এই মশার শিকার হয়।
মশা কামড়ালে, শিশুর ত্বকে কামড় সঙ্গে সঙ্গে দেখা নাও যেতে পারে, তবে কিছুক্ষণ পরে বা কয়েক ঘণ্টা পরেও কামড়ের চুলকানি এবং ফোলাভাব হয়। তিনি বলেন, বাচ্চাদের প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দ্রুত বিপাক হয়, বেশি নড়াচড়া এবং দৌড়াদৌড়ি করার কারণে ব্যায়াম হয় এবং তাপমাত্রা বেড়ে ঘাম হয় ও দেহ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়। মশা কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে শিশুদের কামড়াতে যায়। শিশুরা বেশি নড়াচড়া করার কারণে মশার জন্য আরও দৃশ্যমান এবং আকর্ষণীয় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
এসডব্লিউএসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ