আধুনিক এ বিশ্বে এখনো অনির্ণেয় রোগ আছে। এসব রোগকে বিরল রোগ বলা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এখনো রহস্যজনক এই বিরল রোগের কোনো কূলকিনারা নেই। মোটাদাগে বলা হচ্ছে, সারা বিশ্বে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ এমন রহস্যজনক রোগে আক্রান্ত। শিশুরাও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
হেলেন সেডাররোথ ও মাইক দম্পতি এমনই একটি ভুক্তভোগী পরিবার। এই দম্পতি রহস্যজনক রোগে তাঁদের তিন সন্তানকে হারিয়েছেন। রোগের উপসর্গ শুরুর সময় থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাঁরা সন্তানদের নিয়ে অসংখ্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন। ভিন্ন দেশের চিকিৎসকের কাছেও গিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কোনো সমাধান দিতে পারেননি। সবাই বলেছেন, কিচ্ছু হয়নি। এমনিই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক কিছুই হয়নি। উল্টো তিন সন্তানকেই হারাতে হয়েছে তাঁদের।
১৯৮৩ সালে হেলেনের ছেলে উইলহেমের জন্ম হয়। নানা সমস্যা নিয়ে উইলহেম তাঁর কোলজুড়ে আসে। কিন্তু প্রথম দেখায় কোনো সমস্যা ছিল না। টুকটুকে লাল গাল ছিল তার। হাসপাতালের সবাই ভেবেছিল, সে পুরো সুস্থ শিশু।
তবে উইলহেমের বয়স এক বছর হতে না হতেই তার মৃগীরোগ এবং দীর্ঘস্থায়ী পেটের সমস্যা দেখা দেয়। তিন বছর বয়সে তাঁর ওপরের শ্বাসনালিতে প্রদাহ (ফলস ক্রুপ) হয়। তখন পরিবারকে জানানো হয়েছিল, উইলহেমের হাঁপানি আছে। মা হেলেন এ কথায় ভরসা পাননি। তিনি আরও বেশি কিছু জানতে চেয়েছিলেন। কেন এ রোগ হলো, আর নিরাময়ই-বা কী, তা জানতে চেয়েছিলেন তিনি। হেলেনের পরিবারে সেই প্রথম রহস্যজনক রোগের অভিজ্ঞতার শুরু হয়।
অজ্ঞাত রোগের কোনো কারণ জানা যায় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যায় না। তবে এমন অজ্ঞাত রোগ তুলনামূলকভাবে বিরল। সারা বিশ্বে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ এমন বিরল রোগে আক্রান্ত। বিরল রোগ অর্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাধারণ জনসংখ্যার প্রতি দুই হাজার মানুষের মধ্যে একজন বা যুক্তরাষ্ট্রে দুই লাখের কম মানুষকে প্রভাবিত করে বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৫০ শতাংশ এই বিরল রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৩০ শতাংশের পাঁচ বছর বয়সের আগে মৃত্যু হয়। শুধু যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর ছয় হাজার শিশু ‘নামহীন রোগ’ (সোয়ানিস) বা অনির্ণেয় রোগ নিয়ে জন্ম নেয়।
এমন রোগে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা করানো বেশ কঠিন। লন্ডনের গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতালের নামহীন রোগে আক্রান্ত শিশুদের ক্লিনিক্যাল নার্স বিশেষজ্ঞ অ্যানা জিউইট বলেন, কখনো কখনো অভিভাবকের উদ্বেগ সত্ত্বেও জানানো হয়, শিশু স্বাভাবিক আছে। তারপরও শিশুর রোগ নির্ণয় করা যাচ্ছে না, এটা শোনা মা-বাবার জন্য সবচেয়ে খারাপ শব্দ।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, অধিকাংশ শিশু যারা বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যায়, তাদের জটিল কোনো রোগ নেই। সাধারণত এমন রোগ অস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তারপরও মা-বাবা আশ্বাস চান, তাঁদের সন্তান ভালো আছে।
মেরিল্যান্ডের বেথেসডায় ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর উইলিয়াম গাহল বলেছেন, সন্তানের চিকিৎসার জন্য আসা অভিভাবকদের অধিকাংশই এমন আশ্বাস চান যে তাঁর সন্তানের কিছুই হয়নি। তবে কিছু ক্ষেত্রে এ কৌশল বিপরীতমুখী হতে পারে। যেমনটি উইলহেমের সঙ্গে হয়েছিল।
চিকিৎসকেরা হেলেন ও তাঁর স্বামী মিককে আশ্বস্ত করেছিলেন, তাঁদের সন্তানের খারাপ কিছু হয়নি। তার কেবল মৃগীরোগ, হাঁপানি ও ওপরের শ্বাসনালিতে প্রদাহ আছে। কিন্তু হেলেন ও মিক এ আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারেননি। তাঁরা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করার চাপ দেন।
হেলেন বলেন, ‘এভাবেই অনেক দিন কেটে যায়। উইলহেম স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে দারুণ সময় কাটাত। সে খুব সহমর্মী ছিল। শিক্ষকেরা মজা করে বলতেন, সে একদিন জাতিসংঘের মহাসচিব হবে। সে ছিল সাধারণ ছেলের মতোই একজন।’
সাধারণ শিশুদের মতোই উইলহেম ও তার বড় বোন স্কুল থেকে নানা ধরনের সংক্রমণ নিয়ে বাড়ি ফিরত। কিন্তু উইলহেমের ওই সংক্রমণ সারতে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগত। উইলহেমের বয়স তখন পাঁচ। একদিন বিকেলে রাসবেরি তুলে ঘরে এলে তার তীব্র কাশি শুরু হয়, চোখ লাল হয়ে যায়।
মুখ ফুলে যায়, পরে তীব্র জ্বর শুরু হয়। এত উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও তেমন কোনো কিছু শনাক্ত করতে পারেননি চিকিৎসকেরা। চিকিৎসকেরা হেলেনকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, উইলহেমের এসব উপসর্গের কারণ যা-ই হোক না কেন, তা বংশগত কোনো রোগ নয়। উইলহেমের বয়স যখন আট বছর, তখন হেলেন ও মিকের তৃতীয় সন্তান হুগোর জন্ম হয়।
প্রকৃতপক্ষে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে অনির্ণেয় ও বিরল রোগ বংশগত হয়ে থাকে। কিন্তু গাহল উল্লেখ করেছেন, অধিকাংশ চিকিৎসকই জেনেটিসিস্ট নন। চিকিৎসকেরা প্রায় মা-বাবাকে আশ্বস্ত করেন যে তাঁরা আরও সন্তান নিতে পারেন। যেহেতু ওই চিকিৎসক বংশগত কারণ জানেন না, তাই তিনি শতকরা পুনরাবৃত্তির হারেরও অনুমান করতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘কখনো কখনো সাধারণভাবেই এটা যে বংশগত তা মনে করা হয় না। এটা ঠিক নয়।’
হুগোর জন্মের আগে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে হেলেন পেটে অদ্ভুত নড়াচড়া অনুভব করেছিলেন, যা তাঁকে মৃগীরোগে আক্রান্ত ছোট বাচ্চার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। এমন অনুভূতি তিনি উইলহেম বা তার বড় বোনের জন্মের সময় পাননি। তবে চিকিৎসকেরা তাঁকে বলেছিলেন, এটি শিশুর হেঁচকি।
১৯৯১ সালের ২৭ ডিসেম্বর হুগোর জন্ম হয়। মাত্র ছয় ঘণ্টা বয়সেই তার প্রথম খিঁচুনি আসে। পরে হেলেনের সন্দেহই সঠিক হয়—হুগোর মৃগীরোগ। এ কারণে জীবনের প্রথম ছয় মাস হুগোকে হাসপাতালে থাকতে হয়। হেলেনের পরিবার আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
অ্যানা জিউইট বলেন, অনেক চিকিৎসক মা-বাবার সন্তানের উপসর্গসংক্রান্ত অভিযোগ বিশ্বাস করতে চান না। অনেকে এমন মাকে অত্যধিক উদ্বিগ্ন মা বলেও আখ্যা দেন। অন্য যাঁরা সুবিধাবঞ্চিত ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসেন, তাঁরা মনে করেন, তাঁদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে।
অ্যানা জিউইট আরও বলেন, হুগোর বয়স যখন ১৮ মাস, তখন হেলেনকে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, হুগো কখনো একা হাঁটতে বা বসতে পারবে না। কিন্তু যেদিন তাঁরা হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরেন, সেদিনই হুগো নিজে নিজে সোফায় উঠে গেছে। সে একেক করে আট ধাপ হেঁটে চিকিৎসকদের ভুল প্রমাণ করেছে। পরে হুগো শুধু হাঁটা নয়, দৌড়েও বেরিয়েছে।
এরপর হেলেন চতুর্থবারের মতো আবারও অন্তঃসত্ত্বা হন। এবার মেয়েসন্তান হবে। হেলেনকে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, উইলহেম ও হুগোর ক্ষেত্রে যেমন উপসর্গ (মৃগীরোগ) অনুভব করেছিলেন, এবার তেমন হবে না। এসব কেবল ছেলেদের ক্ষেত্রে হয়। ১৯৯৪ সালের ১৪ জানুয়ারি হেলেন এমা নামের কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু জন্মের ৩০ মিনিটের মাথায় এমার খিঁচুনি শুরু হয়।
এমা চঞ্চল প্রকৃতির। কিন্তু সে অটিজম, মৃগীরোগ ও স্লিপ অ্যাপনিয়ায় (ঘুমের ভেতর দম বন্ধ হয়ে যাওয়া) আক্রান্ত। তিন সন্তানের কেন একই রকম উপসর্গ তা জানতে হেলেন ও মিক লন্ডনের গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতাল ও মেরিল্যান্ডে বাল্টিমোরের জন হপকিনস ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করেন। কিন্তু এখানকার চিকিৎসকেরা এসব উপসর্গের কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেননি। তাঁরা শিশুদের এ অবস্থাকে ‘প্রকৃতির নির্মমতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
উইলহেম ১২ বছর বয়সে পৌঁছানোর পর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তার চাইল্ডহুড ডিমেনশিয়া শুরু হয়। সাইকেল চালানো ভুলে যায়। পড়াশোনা ভুলে যায়, এমনকি নিজের দাদিকেও একসময় চিনতে পারে না। সবকিছু থেকে সে পিছিয়ে যেতে থাকে।
পরে অস্ট্রিয়ায় দেশটির মেডিকেল নীতি কমিটির অনুমতি নিয়ে উইলহেমের চিকিৎসা শুরু হয়। তিন ভাইবোনের কোনো মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ থাকতে পারে কি না, তা ১৯৯৭-৮৭ সালে একটি ফ্রাঙ্কো-সুইস দল গবেষণা শুরু করেন। হেলেন ও সন্তানদের ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করা হয়। কিন্তু কোনো সমাধান মেলেনি। গাহল বলেন, ১৯৯০-এর দশকে জিনোম সিকোয়েন্সিং পদ্ধতি উইলহেমকে সাহায্য করার জন্য খুব সেকেলে ছিল।
১৫ বছর বয়সে স্পষ্ট হয়ে যায়, উইলহেম আর সুস্থ হবে না। তাকে বাড়িতে একটি নার্সিং দলের সহায়তায় প্যালিয়েটিভ কেয়ারে রাখা হয়। ১৯৯৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কোনো সুস্পষ্ট কারণ পাওয়া যায়নি।
উইলহেমকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন হেলেন ও মিক। এরই মধ্যে উইলহেমের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার তিন সপ্তাহ পরই প্রথমবার কোমায় চলে যায় ছোট্ট এমা। চিকিৎসক জানিয়ে দেন, তাঁদের কিছুই করার নেই। পরে কোমা থেকে ফিরে এলেও ২০০০ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র ছয় বছর বয়সে বাড়িতে তার মৃত্যু হয়। এর প্রায় দুই বছর পর ২০০২ সালের ৪ ডিসেম্বর ১১তম জন্মদিনের আগে হুগোরও মৃত্যু হয়। মৃগীরোগের পাশাপাশি তার ফুসফুসে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল।
এই তিন শিশুর ঠিক কী হয়েছিল, তা নির্ণয় করা যায়নি। আবার এই তিন শিশুর নামহীন রোগের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা-ও জানা যায়নি। তারা যদি আরও কয়েক বছর পরে জন্ম নিত, তাহলে হয়তো তা জানা যেত। চলতি বছর যুক্তরাজ্যে গুরুতর বিকাশজনিত ব্যাধিসহ এমন হাজারো শিশুর একটি রোগ নির্ণয় করা গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ওই সব শিশুর মধ্যে ৬০টি নতুন রোগের সন্ধান পাওয়া গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে রোগনির্ণয়ের নেটওয়ার্ক সারা দেশে ১২টি গবেষণা দল ও ক্লিনিক্যাল কেন্দ্রের সমন্বয়ে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম এমন রোগের রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করছে। ২০১৮ সালে এই কনসোর্টিয়াম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র দুই বছর পরেই ৩১টি নতুন উপসর্গ শনাক্ত ও ১৩২ জন রোগীর রোগ নির্ণয় করা হয়।
আর বর্তমানে এই কনসোর্টিয়াম ২ হাজার ২২০ জনের বেশি রোগীর মূল্যায়ন করেছে এবং সফলভাবে তাঁদের মধ্যে ৬৭৬ জনের রোগ নির্ণয় করেছে। এর মধ্যে ৫৩টি নতুন শর্ত বর্ণনা করেছে।
তবে এ ধরনের কাজের বড় একটি সমস্যা হলো তহবিল। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ কমন ফান্ড থেকে আনডায়াগনোজড ডিজিজেস নেটওয়ার্কের জন্য তহবিল এ বছরই শেষ হতে যাচ্ছে।
অনির্ণেয় রোগে তিন সন্তানের মৃত্যুর পর হেলেন ও মিক উইলহেম ফাউন্ডেশন নামে একটি দাতব্য সংস্থা চালু করেছেন। সংস্থাটি অনির্ণেয় রোগ নির্ণয়ে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে তাঁরা অনির্ণেয় রোগের ওপর একটি বিশ্ব সম্মেলনের আয়োজন করে শীর্ষ বিশেষজ্ঞদের একত্র করেছিলেন। এ নিয়ে সমাবেশ এখনো চলছে।
এদিকে প্রায় দুই বছর আগে হেলেন ও মিক একজন শীর্ষ ডায়াগনস্টিক জেনেটিসিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ওই চিকিৎসকের ধারণা, তাঁদের সন্তানদের সম্ভবত একটি নতুন রোগ হয়েছিল। সন্তানদের পুরো জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য জিনগত নমুনা জমা দিয়েছেন তাঁরা। অন্যদের জীবন বাঁচাতে হয়তো এ পরীক্ষা কাজে দেবে।
এসডব্লিউএসএস/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ