ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগে প্রতি বছর ৪০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি বলছে, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এসব অঞ্চলের বেশির ভাগই শহর ও উপশহর। যদিও অনেক সংক্রমণ উপসর্গবিহীন বা শুধু হালকা অসুস্থতা তৈরি করে। তবে প্রায়ই এ ভাইরাসে সৃষ্ট জ্বর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ডেঙ্গুর জন্য নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। প্রাথমিকভাবে শনাক্তকরণ ও উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা রোগীকে সুস্থ করে তোলে এবং মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমিত এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস মশার কামড়ে মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু রোগ ছড়ায়। ডেঙ্গু প্রায়ই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অসুস্থতার একটি প্রধান কারণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটছে। আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জসহ বিশ্বের অনেক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে।
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছেই। মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে মশাবাহিত সংক্রামক এ রোগটি। একদিনে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছে ১৯ জন, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। হাসপাতাল ও বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা।
বাসায় থেকেও চিকিৎসা নিচ্ছে অনেকে। অন্যান্য বছরের তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেক বেশি হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। এ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। তারা বলছেন, শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য এ রোগে এত মৃত্যুর হার দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গতকাল ১৯ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে ১৭ জনই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা। বাকি দুজনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকার বাইরে। এ নিয়ে সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ১৪৬। চলতি মাসের ১৮ দিনেই প্রাণ হারিয়েছে ৯৯ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো হাসপাতালভিত্তিক ডেঙ্গুবিষয়ক বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে আরো ১ হাজার ৭৯২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছরের শুরু থেকে সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৭৯২।
তাদের মধ্যে জুলাইয়ের ১৮ দিনে ভর্তি হয়েছে ১৭ হাজার ৮১৪ জন। নতুন রোগীদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ৯২২ জন ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৮৭০ জন ভর্তি হয়েছে। আর মারা যাওয়া ১৯ জন রোগীর মধ্যে ১৭ জনই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা।
বর্তমানে ৫ হাজার ৫৫২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে রাজধানীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার আর সারা দেশে অন্যান্য হাসপাতালে সোয়া দুই হাজার রোগী।
সরকারের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের। জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনেই সেই সংখ্যা বেড়ে তিন গুণ হয়েছে।
তার আগে জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩ ও মে মাসে ১ হাজার ৩৬ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। ভর্তি রোগীদের মধ্যে জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে তিন এবং এপ্রিল ও মে মাসে দুজন করে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন সম্প্রতি জানিয়েছেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরনের (ডেন-১, ২, ৩ ও ৪) মধ্যে এবার একাধিক ডেন সক্রিয় রয়েছে।
তারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ২০০ নমুনা সংগ্রহ করে তাতে ডেন-১ ও ৪-এ আক্রান্তের হার বেশি পেয়েছেন। একাধিক ডেনে আক্রান্ত রোগীরাই বেশি মারা যাচ্ছে।
দেশে ডেঙ্গু জনস্বাস্থ্যের জন্য সর্বোচ্চ ঝুঁকি তৈরি করেছে বলে মনে করছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মশাবাহক রোগ নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি, এলাকাভিত্তিক রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে ডেঙ্গু দেশের অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জীবাণুটির বাহক এডিস মশা নির্মূলে ও রোগী ব্যবস্থাপনায় জনস্বাস্থ্যের চিন্তাভাবনা উপেক্ষিত। শুরু থেকেই সমন্বিত উদ্যোগের ঘাটতি। তাই সব অঞ্চলে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে এ রোগ। বিশ্বের শতাধিক দেশে বছরে অর্ধশত কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশে। শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য হলেও এ রোগের চিকিৎসা ও রোগী ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না মৃত্যু।
চলতি বছরের ৮ জুন পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ২২ লাখ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা ইউরোপীয় রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (ইসিডিসি)। সংস্থাটি বলছে, সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয়। ক্রমধারা অনুযায়ী দেশগুলো হচ্ছে ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু ও আর্জেন্টিনা।
এরপর অন্য দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, আফগানিস্তান, লাওস, কম্বোডিয়া, চীন, অস্ট্রেলিয়া, ফিজি, ভানুয়াতু, মালদ্বীপসহ অন্তত ১০০টি দেশ। তবে আক্রান্ত রোগীদের অনুপাতে মৃত্যুর হার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি।
সরকারের দেয়া তথ্য সারা দেশের প্রকৃত ডেঙ্গুর চিত্র নয় বলে জানিয়েছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মূলত রাজধানী ঢাকায় ২০টি সরকারি ও ৪৬টি বেসরকারি হাসপাতালে যেসব ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে তাদের তথ্য কেবল দেয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে জেলা হাসপাতালের তথ্য।
তবে এর বাইরে অসংখ্য রোগী সারা দেশের বিভিন্ন ক্লিনিক, ছোট-বড় হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসা নিলেও সে তথ্য নেই সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নকারী ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটির কাছে।
বিশ্বে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৭৮০ সালে। এশিয়ার থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে ১৯৫০ সালে ডেঙ্গু সংক্রমণ ছড়ায়। ১৯৬৩ সালে ভারতের কলকাতা ও ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু। ওই সময় রোগটিকে ঢাকা ফিভার নামে অভিহিত করা হয়।
তবে সরকারিভাবে ডেঙ্গুকে রোগ হিসেবে দেখা হয় মূলত ২০০০ সালে। সে বছরই সাড়ে পাঁচ হাজার ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ৯৩ জনের। ২০২২ সালে ৬১ হাজার রোগীর মধ্যে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়, যা কিনা এখন পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যুর রেকর্ড। এর আগে ২০১৯ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে গত ২২ বছরে দেশে আড়াই লাখের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে মারা গেছে ৮৫০ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর রাজধানী ঢাকায় ভর্তি রোগীদের মধ্যে ১১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ৮৯ জনই ভর্তি ছিল সরকারি হাসপাতালে। সবচেয়ে বেশি ভর্তি হয়েছে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এ হাসপাতালে ৪ হাজার ২৩০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের। এর পরই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবস্থান। সেখানে চিকিৎসা নিতে যাওয়া ১ হাজার ৬২৩ রোগীর মধ্যে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এ বছর ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর হার যে গতিতে বাড়ছে, তাতে বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, ‘গত ২৩ বছর ধরে ডেঙ্গুকে গুরুত্ব দেয়া হলেও তা মূলত মৌসুমকেন্দ্রিক কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ ছিল। কোনো রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে যে অবস্থানে থেকে কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন তা হয়নি। রোগীর অনুপাতে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। কেননা রোগীরা শেষ মুহূর্তে চিকিৎসার আওতায় আসছেন। আর যে রোগী ও মৃত্যু সংখ্যা আমরা জানছি তা হাসপাতালভিত্তিক। এর বাইরে যেসব রোগী রয়েছে এবং মৃত্যু হচ্ছে তা হিসাবের বাইরে থাকছে। রয়েছে কৌশলগত পর্যবেক্ষণের ঘাটতি।’
এর আগে গত রোববার রাজধানীতে ডেঙ্গুবিষয়ক এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এ রোগতত্ত্ববিদ বলেছিলেন, ‘চলতি বছর মশাবাহিত সংক্রামক রোগ ডেঙ্গু উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এ মুহূর্তে দেশে জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য সিটি করপোরেশনগুলো বিভিন্ন এলাকায় জরিমানা করছে। তবে জরিমানা করে জনস্বাস্থ্যের সমস্যার সমাধান করা যায় না। বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।’
যদিও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ওইদিন এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, সাধারণত এডিস মশা দিনের বেলায় কামড়ায়, পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে এমনটি জানা থাকলেও এখন ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। অপরিষ্কার ও নোংরা পানিতেও এডিসের লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। এ মশা রাতে-দিনে সব সময়ই কামড়াচ্ছে। রোগীদের মধ্যে যারা শক সিনড্রোমে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি।
এখন আগের মতো ডেঙ্গু রোগীর শরীরে উচ্চতাপমাত্রার জ্বর দেখা যাচ্ছে না। শরীরের ব্যথা, কয়েকদিনের জ্বর থাকছে না। প্লাটিলেট কমে গেলেও বোঝা যাচ্ছে না। এখন সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা হচ্ছে। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। রক্তচাপ কমে যাচ্ছে, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, রোগী অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, যা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম নামে পরিচিত। এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ শক সিনড্রোম।
এসডব্লিউএসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ