ভারতে মসজিদ ভাঙা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজিপির শাসনে। ২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর দিল্লী সংলগ্ন গুরগাঁওয়ের একটি মসজিদে নামাজ পড়ার সময় ভিতরে ঢুকে মারধর এবং ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ ওঠে। এক বছর পর ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর মাকতুব মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানিসাগরের রাওবাজার এলাকার মুসলিমদের বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়েছিল। থানায় যে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল তাতে অবশ্য নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ থাকলেও, তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়নি। মানবাধিকার সংগঠন এপিসিআর সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখে জানিয়েছিল, হিন্দুত্ববাদীরা কমপক্ষে ২৭টি হামলা চালিয়েছিল। ভিএইচপির লোকেরা ১৬টি মসজিদে হামলা চালিয়েছিল। কয়েকটি মসজিদে জোর করে ভিএইচপির পতাকা পুঁতে দেয়া হয়েছিল। কমপক্ষে তিনটি মসজিদে আগুন ধরানো হয়েছিল। উনাকটি জেলার পালবাজার মসজিদ, গোমতী জেলার ডোগরা মসজিদ এবং বিশালগড় জেলার নারোলা টিলা মসজিদে আগুন লাগানো হয়।
তবে এবার দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। ভারতে কাছাকাছি সময় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এতটাই চরমে উঠলেও যে সেখানে বেশ কবার তা সহিংস রূপ নিয়েছে। কিন্তু পাঞ্জাবে দেখা গেছে ভিন্ন কিছু।
ঘৃণার দম বন্ধ করা পরিবেশে বন্ধুত্বের অন্য গল্প লিখছে পাঞ্জাব। ভাটিন্ডার বখতগড়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। মসজিদের জন্য জমি দিয়েছেন অমনদিপ সিং নামে এক কৃষক। তিনি শিখ। মসজিদ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ২ লাখ টাকাও জোগাড় করেছেন ওই গ্রামের শিখ ও হিন্দুরা মিলে। মসজিদ নির্মাণে প্রয়োজনীয় সিমেন্ট আর ইটের জোগান দিয়েছেন পাশের শিখ ও হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামের মানুষজন। এ তো গেল একটা মসজিদের কথা। এমন প্রায় ১৬৫টি জরাজীর্ণ মসজিদ খুঁজে বের করে সেগুলো পুনঃনির্মাণ করে স্থানীয় মুসলমানদের হাতে তুলে দিয়েছেন পাঞ্জাবের শিখ ও হিন্দুরা।
গত ৯ বছরে বিভিন্ন মসজিদের নিচে শিবলিঙ্গ খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে মাদরাসা। কোথাও ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে বলতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে মসজিদে রাখা জায়ানামাজে। এমন ঘৃণার পরিবেশে সম্প্রীতির নজির তৈরি করছে পাঞ্জাবের শিখ ও হিন্দুরা। যে সব এলাকার মুসলমানরা দরিদ্র, সেখানে মসজিদ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ড থেকে শুরু করে সবরকম দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন এলাকার শিখ আর হিন্দুরা। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেখানকার গুরুদ্বারাগুলো।
পাঞ্জাবে মুসলমানরা সংখ্যায় কম হলেও সেখানে প্রচুর মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলো এতটাই পুরোনো যে সেই সব মসজিদের দেয়াল থেকে প্লাস্টারও খসে পড়েছে। কারণ দেশ ভাগের আগে পাঞ্জাবে মুসলমানদের বাস ছিল। স্বাধীনতার আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে মুসলমানরা পাকিস্তানে চলে যান। নবনির্মিত পাঞ্জাবে তখন সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন মুসলমানরা। যার কারণেই অনেক মসজিদে নামাজ পড়ার কেউ ছিল না। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এখন সেগুলো ফের নতুন করে নির্মাণ করার কাজ শুরু করেছেন শিখ ও হিন্দুরা।
এখন পাঞ্জাবে মসজিদের প্রয়োজন বেড়েছে। কারণ হিমাচল প্রদেশের মুসলমানরা দলে দলে এসে পাঞ্জাবে থাকতে শুরু করেছেন। হিমাচল প্রদেশের বনাঞ্চলে গুজ্জর মুসলমানদের বাস ছিল। সম্প্রতি সে রাজ্যের উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল ও বন আধিকারিকদের চাপে বনাঞ্চল ছেড়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা পাঞ্জাবে বাস করা শুরু করেছেন।
যে কোনো নির্বাচনের আগে ঠান্ডা ঘরে বসে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে। এরপর কোথাও গোরক্ষার নামে চলে নৃশংসতা। কখনো বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকাতে তৈরি করা হয় ‘দ্য কেরালা স্টোরি’, ‘কাশ্মীর ফাইলস্’, ‘বাহাত্তর হুরে’-র মতো ছবি। এই সবের মাঝে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে শিখ ও হিন্দুদের প্রচেষ্টা নজর কাড়ছে গোটা ভারতবাসীর।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২২
আপনার মতামত জানানঃ