ভারত থেকে আমদানি করা কাঁচামরিচের ট্রাক বাংলাদেশের সীমান্তে ঢোকার সাথে সাথে বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্যটির ব্যাপক দরপতন শুরু হয়েছে। দুদিন আগেও যেখানে এক হাজার টাকা কেজিতে কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে। সেটি এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। রবিবার বিকেল থেকে আমদানির ট্রাক পৌঁছতেই দাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় নামতে থাকে। সামনে দাম আরও কমবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
একই চিত্র দেখা গিয়েছিল গত রমজান মাসে পেঁয়াজের বাজারে। মার্চের শুরুতে দেশের বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ যেখানে বিক্রি হয়েছিল ৩০-৪০ টাকায়। মার্চের শেষে সেই দাম ধাপে ধাপে বাড়তে বাড়তে প্রতি কেজি ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। মূলত স্থানীয় কৃষকদের সুরক্ষা দিতে ১৬ই মার্চ পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখার পরই দামের ওপর এমন প্রভাব পড়তে দেখা যায়।
কেন এই দাম বৃদ্ধি!
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সে সময় বাজার পরিস্থিতি সরেজমিনে ঘুরে এসে নিজেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, দেশে চাহিদার চাইতে বেশি পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়েছে, যথেষ্ট মজুদ আছে। কোন সংকট নেই। অথচ আমদানি বন্ধের দোহাই দিয়ে, সরবরাহ সংকট দেখিয়ে পেঁয়াজের বাজারকে অস্থির করে তোলা হয়েছিল। আবার আমদানির ঘোষণা আসতেই পেঁয়াজের দাম আবার হু হু করে পড়ে যায়।
এক পর্যায়ে হিলিতে পড়ে থেকে পেঁয়াজ পচার খবরও শিরোনাম হয়েছে। ব্রয়লার মুরগি, ডিম, চিনি, ভোজ্য তেল, আটা- ময়দা, আদা-জিরাসহ বিভিন্ন ধরণের মসলার বাজারেও বিভিন্ন সময়ে এমন অস্থিরতা দেখা গিয়েছে। যেসব ভোগ্যপণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় সেগুলোর দাম বাড়ার পেছনে ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ’, ‘বৈশ্বিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি’ ও ‘ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন’ – ইত্যাদি নানা দোহাই দেওয়া হয়।
আবার দেশি পণ্যের ক্ষেত্রে ‘উৎপাদনে ঘাটতি’র ধুয়া তুলে দাম লাগামহীন বাড়ানো হয়। যেকোনো উৎসবের আগে এমন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এভাবে বাড়িয়ে দেয়া এখন যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ক্ষেত্রে উৎপাদনে ঘাটতি নয়, বরং অভিযোগের তীর উঠেছে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ভোক্তা অধিকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই চক্র তাদের ইচ্ছেমত সময় বুঝে সবকিছুর দাম নিয়ন্ত্রণ করছে, পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে লাগামহীন দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু তাদেরকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ সভাপতি নাজির হোসেন বলেছেন, বাজারের এই অস্থিরতা একটাই বার্তা দিচ্ছে, সেটা হল ব্যবসায়ীরা চাইলে ভোগ্যপণ্যের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারে বা পণ্যের সরবরাহ কমাতে পারে।
এভাবে তারা শক্তি প্রদর্শন করে দাম কমাতে পারে, আবার বাড়াতেও পারে। এখানে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করে তিনি বলেন, সরকার দীর্ঘদিন ধরে বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা বলে আসলেও সেই জায়গাতে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।
“সরকার এই কারসাজির সাথে জড়িত কিছু সিন্ডিকেটকে শনাক্ত করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা কমিশন মামলা করলেও কাউকে আইনের আওতায় আনতে দেখা যায়নি। বরং সরকার মনে করছে যে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়ে উঠবে। এভাবে ওই সিন্ডিকেটকে দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছে। যার ফলেই বাজারে এই অস্থিরতা। কারণ কারসাজি করলেই তো পার পাওয়া যায়।”
এমন অবস্থায় বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা বাড়ানো সেইসাথে অসাধূ ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা খুবই জরুরী বলে তিনি মনে করেন।
অভিযোগ আছে যে, এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা মূলত উৎসবকে টার্গেট করে থাকে – কারণ সে সময় আমদানি সাময়িক বন্ধ থাকে, সরকারি কর্মকর্তারা ছুটিতে থাকেন।
আবার বছরের যেকোনো সময় সরকারের আমদানি বন্ধের ঘোষণারও সুযোগ নিয়ে থাকেন তারা।
অন্যদিকে ক্রেতা অধিকার সংগঠনগুলো পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা বা বাজার ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির বিষয়টিকে চিহ্নিত করেছে। তারা বলছেন, সরকারের নিয়ন্ত্রণের অভাবে পণ্যের বাজার পর্যালোচনা করে সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি দেখাশোনা করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন-টিসিবি। বাজারে পণ্যের নির্ধারিত মূল্যের বিষয়টি তদারকি করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এবং বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এছাড়া কৃষি অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারি করে থাকে। এক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের বাজার মনিটরিংয়ের যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে বলে মনে করেন মি. হোসেন।
এক্ষেত্রে তিনি লোকবলের অভাবের বিষয়টিকে সামনে এনে বলেন, “একটি জেলায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মাত্র একজন কর্মকর্তা ও তার এক সহকারী দায়িত্বে থাকেন। তার পক্ষে এতোগুলো উপজেলায় ঘুরে ঘুরে বাজার মনিটর করা অসম্ভব। ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কাজ করছেন হাতে গোনা কয়েকজন।”
“তাদেরও কাজের সময়ের বড় অংশ ব্যয় হয় বিভিন্ন দপ্তরের সাথে সমন্বয়ের কাজে। তারা বাজার মনিটরিংয়ের মতো সময় পান না। এজন্য আমরা কর্মী নিয়োগ ও লজিস্টিকস সুবিধা জন্য আবেদন করেছিলাম – কিন্তু সবই থমকে আছে।”
বেশ কয়েকটি এলাকায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সীমিত আকারে অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু সেটির কার্যকর কর ফল দেখা যায়নি, কারণ এই নজরদারি শুধুমাত্র খুচরা বাজার কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। কিন্তু পণ্যের লেনদেন শুধু খুচরা পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত হয় না বরং এটি উৎপাদন, পাইকার, আড়ত পর্যায় থেকেও নিয়ন্ত্রিত হয়।
বর্তমান বাস্তবতায় বাজারের প্রতিটি পর্যায়ে সরকারের নিয়মিত নজরদারি খুব জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
সরকারের রাজনৈতিক দুর্বলতা
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় জাতীয় সংসদে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। সেসময় বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করে বলেছেন যে, বড় বড় গ্রুপগুলো একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে। চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।
তবে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বাজারে হঠাৎ যে সংকট তৈরি হবে, সেটা সইতে কষ্ট হবে। এজন্য আলোচনার মাধ্যমে নিয়মের মধ্যে থেকে চেষ্টা করার কথা জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, ‘সবকিছু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঠিক করে না। তারপরও আমি দায় নিয়ে বলছি আমরা সর্বোতভাবে চেষ্টা করছি কী করা যায়।’
সরকারের পক্ষ থেকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যাপারে নানা রকম আশ্বাস দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত বাজার দুষ্টচক্রের কব্জায় চলে যায়। এর ফলে সরকার বিভিন্ন নিত্য-পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক ও ডিউটি প্রত্যাহার, বেসরকারি উদ্যোগে আমদানির সুযোগ বা ভর্তুকি সুবিধা দিলেও সেই সুফল সাধারণ মানুষ পায় না।
নিয়ন্ত্রণহীন বাজার নিয়ে এতো অভিযোগ বিশেষ করে অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেটের কথা বারবার উঠে এলেও সরকারি কোনও হস্তক্ষেপই যেন কাজে আসে না বলে বাজার বিশ্লেষকদের ধারণা। এই অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বেপরোয়া নীতির কারণে ভোগ্য পণ্যের পাইকারি ও খুচরা বাজার দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার দিকে যাচ্ছে বলে তারা উল্লেখ করেন।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দামের এই অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের পেছনে বাজারের সাপ্লাই চেইনটি ইনফরমাল হওয়াকে দায়ী করছেন। তার মতে, পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে অর্থাৎ কৃষক থেকে শহরের আড়তদার, ফড়িয়া, পাইকার, খুচরা পর্যায় হয়ে ভোক্তার হাত পর্যন্ত পৌঁছানোর পুরো নেটওয়ার্কটি কোন সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নেই।
এরকম একটি বাজার কাঠামোতে যেকোনো পর্যায়ে, যে কারও পক্ষে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নেয়া, হস্তক্ষেপ করা এবং বাজারকে প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে বলে তিনি মনে করেন। সেটা পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি থেকে শুরু করে, হঠাৎ সব পণ্য ছেড়ে দিয়ে দাম কমিয়ে ফেলাও হতে পারে।
কিন্তু এই বাজার কাঠামো যদি ফরমাল হত তাহলে পুরো সাপ্লাই চেইনে যারা জড়িত তারা সবাই নিবন্ধিত হতেন, তাদের লেনদেন, মজুদ, বিক্রির সব তথ্য লিপিবদ্ধ থাকতো, বলেন তিনি। তিনি বলছেন, তাহলে জানা যেত যে কে কোথায় মজুদ রাখছেন, কি পরিমাণ মজুদ রাখছেন, কি পরিমাণ বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এতে বাজারকে অস্থির করে তোলার প্রবণতা কমে আসতো ।
“বাজার ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাব, তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি, নামে বেনামে পণ্য মজুদ এবং সরকারি নজরদারির অভাবের কারণে বাজারে পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরেও দেখা যায় যে, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সুযোগ নেয়া হচ্ছে এবং পণ্য আমদানির ফলে বাজারে দাম পড়ে যাচ্ছে। এই আমদানির কারণে।“
এ কারণে কৃষি পণ্যের বাজার কাঠামোকে একটি আইনসম্মত এবং প্রাতিষ্ঠানিক বা ফরমাল কাঠামোয় আনা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তার কথায় – যেখানে পুরো সাপ্লাই চেইনে থাকা প্রত্যেকে নিবন্ধিত থাকবেন, তাদের লেনদেন ডিজিটাল পেমেন্ট বা ফরমাল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে হবে, সেইসাথে পণ্য উৎপাদন, মজুদ ও বিক্রির সব তথ্য জানার ব্যবস্থা থাকবে।
আবার বড় বড় কোম্পানির মজুদদারি বা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক দুর্বলতা আছে বলেও জানান খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি জানান, সম্প্রতি চিনি ও তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় কোম্পানির সম্পৃক্ততার বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়ার পরেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সেখান থেকেই বোঝা যায় যে আসলে দুর্বলতা কোথায়।
“আবার বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন যে এসব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সেটা বাজারে বড় বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। এটি আসলে প্রকারান্তরে বাজার ব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকাকে খাটো করছে” – বলছেন মি. মোয়ােজ্জম।
তার মতে, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যদি কিছুদিন নিয়মিত ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে ভবিষ্যতে বাজার প্রক্রিয়ায় একটি বার্তা যাবে যে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করলে শাস্তি পেতে হয়। ফলে বাজারকে নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা কমে আসবে। কিন্তু ব্যবস্থা না নেয়ায় এবং সরকারি মদদে এই ব্যবসায়ীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ